পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/১০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ঝির ঝির করে বেরন জলের ঘোট ঘোট ধারাগুলি। ভূতত্ত্ব-বিজ্ঞানের প্রথম পাঠ আরম্ভ হল আমাদের এখানকার প্রকৃতির ক্রোড়ে। প্রত্যেক বিজ্ঞানশাস্ত্রই মানুষের চিন্তারাজ্য প্রসারিত করে দেয়, কিন্তু ভূতত্ত্ব আর গ্রহনক্ষত্রতত্ত্ব এই দুটির মত মনকে সুদূরগামী, বুদ্ধিকে প্রশস্ত করার সহায়ক বিজ্ঞান আর নেই। দেশের ও কালের গভীর থেকে গভীরতর স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে ভূতত্ত্ব, আর উচ্চ থেকে উচ্চস্তরে উঠানর জন্যে গ্রহনক্ষত্রতত্ত্ব। আকাশ আকাশ আকাশ! ফাঁক ফাঁক ফাঁক! কি অন্তহীন ফাঁকা! যেদিকে চাও সেই দিকেই ফাঁকা! কোথাও কিছুতে আটকান নয়। মনকে একেবারে অনন্তের ধারণায় পাকা করে দেয়। কিন্তু অনন্ত খালি শুন্যতায় ভরলে পর্যাপ্ত হয় না, তার ভিতর একটি পূর্ণতার ভাৰও চাই। তাই ল্যাণ্ডস্কেপ পেণ্টররা বলেন সুবিস্তৃত ফাঁকার মধ্যে একটু জীবনের চিহ্ন থাকলেই তবে তার সৌন্দর্যের সম্পূর্ণতা হয়—সুদূরে একটি পাখী, একটি জানোয়ার বা একটি মানুষ। নয়ত অনন্ত একঘেয়ে ও শ্রান্তিকর হয়ে পড়ে। জীবশরীরবৎ শরীরে আবদ্ধ জীবনের ধারণা না হলেও চলে বোধ হয়। শুধু জীবন্ততার একটি ধারণা চাই। যে অনন্ত অসীম প্রাণ সান্ত সীমাবান সকল প্রাণীর প্রাণের উৎস সেই এক অদ্বিতীয় প্রাণময়কে যদি এই ফাঁকায় ধরতে পারি তবেই আমার অনন্ত শূন্যতা অনন্ত পূর্ণতায় ভরে থাকে। তাই হয়েছিল আমার যখন আমি একবার হিমালয়ে কুলু পাহাড়ে যাচ্ছিলুম আমার পাঁচ বছরের পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে। তখন সেই অবাধ ফাঁকে ছিলুম শুধু আমরা দুটি ও সারা আকাশব্যাপী জীবন্ত ভগবান। কেমন ভগবান আমার? সুপ্ত নয়, জাগ্রত। অপানিপাদ নয়, সর্বতো চক্ষু সর্বত্র শ্রুতিমান গতিবান ব্যাপ্তিবান অন্তর ও বাহিরের আকাশে। আমাদের একটা চোখের জ্যোতি নয়, এমন সহস্র চক্ষের জ্যোতি তাঁর চোখে, একটা কানের শ্রণশক্তি নয়, এমন সহস্র কানের শক্তি। সেই চোখে আমাদের প্রতি নির্নিমেষে চেয়ে আছেন, সেই কানে প্রতি কথাটি শুনছেন। প্রাণময় প্রেমময় তিনি, মৃত নন, কালা কানা হাবা নন-মননময়, বিজ্ঞানজানাময়, জ্ঞানময়, সদা সচেতন, সদাজীবন্ততাময়। এই অনুভূতিটি আমি তখন আমার এক ইংরেজ বান্ধবীকে বর্ণনা করেছিলুম। তাঁর মনে ঐ বর্ণনাটি একটি গভীর রেখা কেটেছিল। বার বার সেটি ফিরে ফিরে আওড়াতেন।

 আমাদের সঙ্গে বোলপুরে যাত্রার পার্টিতে সেবার অনেক লোক ছিলেন। আমাদের প্রায় সমবয়সী, আমাদের চেয়ে অনেক বড়, সব রকমের।

৯২