পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/১১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বোধ হয় বিজ্ঞানের অধ্যাপক। আমার জিদ বজায় রইল, পদার্থ-বিজ্ঞানে আমার প্রাথমিক প্রবেশ লাভ হল, পাসও হলুম এবং সায়ান্স এসোসিয়েশন থেকে একটি রৌপ্যপদক পেলুম। সেই পর্যন্ত ফাদার লাঁফোর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠভাবে জানাশোনা হয়ে গেল। তিনি শুধ, সেণ্টজেভিয়ারের একজন মাস্টার নন, সামাজিক মেলামেশায়—ডিনারে, ইভনিং পার্টিতে, সব আমোদ-প্রমোদে সদা সামিল হন; গল্প-গুজব, হাসিখুশি ও সৌজন্যে ভরা।

 বি-এ ক্লাসে যখন উঠলুম, তখন লক্ষ্ণৌ মিস্‌ থোবার্নের স্কুল থেকে দুটি খ্রীস্টান মেয়ে এসে আমার সহপাঠী হল। একজন বাঙালী শরৎ চক্রবর্তী ও একজন হিন্দুস্থানী—নাম এথেল র‍্যাফেল। শরৎ একেবারে আদর্শ নেটিভ খ্রীস্টান মেয়ে—মিশনারি আগ্রহে ভরা। তার নিজের মুখের কথায় জানলুম—হিন্দু মেয়েদের খ্রীস্টান করার জন্যে তাদের বাড়ি থেকে চুরি করে আনা, লুকিয়ে রাখা, আত্মীয়দের ধোঁকা দেওয়া—সব কিছুতে অভ্যস্ত সে। এথেল আর একরকম প্রকৃতির। সেও খ্রীস্টধর্মে গোঁড়া বিশ্বাসী, কিন্তু ছল-চাতুরির ভিতর দিয়ে যায় না। সুন্দরী নয়, কিন্তু তার চোখ দুটির ভিতর এমন একটি ‘wistfulness’ আছে—দেখলেই তার প্রতি মায়া বসে। রবিমামাও সেটি লক্ষ্য করেছিলেন—যখন তাকে একদিন আমাদের বাড়িতে দেখেন।

 বেথুন কলেজে এসে আমার সহপাঠী হয়ে তার বুকের ভিতর একটা মস্ত আলোড়ন চলতে থাকল। পঞ্জাব ও পশ্চিমে সেকালে দস্তুর ছিল মিশনরিরা কাউকে খ্রীস্টধর্মে দীক্ষিত করলে তাদের বংশগত ভারতীয় নাম ত্যাগ করিয়ে ইংরেজি নামে ভূষিত করত। তাই এথেল এখন ‘মিস্‌ র‍্যাফেল’। তারা বংশে রাজপুত, তার বংশপরম্পরাগত পদবী হচ্ছে ‘সিংহ’। আমাদের সংসর্গে এসে সে জাতীয়তার দ্বারা প্রবলভাবে আক্রান্ত হল। একটা গ্রীষ্মের ছুটিতে লক্ষ্ণৌ গিয়ে সেখানকার ম্যাজিস্ট্রেটকে নোটিস দিয়ে নিজের ‘এথেল র‍্যাফেল’ নাম পরিত্যাগ করে—‘লীলা সিংহ’ নাম পরিধান করলে। বোধ হয় কলকাতার য়ুনিভার্সিটি ক্যালেণ্ডারে তার ‘লীলা সিংহ’ নামই বেরিয়েছিল। ‘লীলা সিংহ’ নামেই, ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরেই সে থোবর্ন কলেজ থেকে আমেরিকায় খ্রীস্টান মেয়েদের প্রতিনিধি হয়ে গিয়েছিল। স্বদেশপ্রীতি তার ভিতর সর্বতোভাবে জাগ্রত হয়ে উঠল। আজকাল মিশনরিদেরও পলিসি হচ্ছে কনভার্টদের দেশীয় নামই বজায় রাখা। বরঞ্চ লাহোরে এই নিয়ে একটা গোলযোগ হয়েছিল।

১০৫