পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/১৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 দ্বিপুদাদার মেজভাই অরুদাদা উর্দুনবীশ ছিলেন। হিন্দুস্থানী বেশ বলতেন, আর উর্দু বইও পড়তেন উচ্চারণে ঠিক জোরদার দিয়ে। কুস্তি প্রভৃতি কসরতের দ্বারা প্রথম যৌবনে শরীরটাও বেশ কায়দায় রেখেছিলেন। তিনি দু-একবার বম্বে অঞ্চলে যান মেজমামার কাছে। গল্প করতেন বম্বে থেকে ফেরার পথে গাড়ি যখন পশ্চিম ও বেহারের স্টেশনে স্টেশনে থাকত, জোর গম্ভীর গলায় কুলিরা স্টেশনের নাম হাঁকত-জব্বল-পো-র, ইলাহা-বা-দি, বক্‌স-র পট-না-া-া!—

 রাত্রে ঘুমন্ত অবস্থায় ভয় পেয়ে উঠতে হত, বুঝি ডাকাত পড়েছে। আর গাড়ি যেমন বাঙলায় পৌঁছল, মিহিগলায় টক্‌ করে একটুখানি আওয়াজ বেরল—“কনু জংশন!’ “বদ্ধোমান!’ আর যারা ডাকছে তারা দেখতে এমন ক্ষীণজীবী—যেন একটা টোকা মারলেই এখনি পড়ে যাবে। অরুদাদার বর্ণনা যে খাঁটি সত্য, তা বিদেশ থেকে প্রত্যাগমনকালে আমাদের সকলেরই অনুভব হত। বাঙালী কুলিরাও মানুষ, আর পশ্চিমের কুলিরাও মানুষ—কিন্তু দেখতে কত তফাৎ! এবার এই ভোজপুরী মারাঠী পঞ্জাবী সকলের সঙ্গে বাঙালীর চেহারাগত দৌর্বল্যের পাহাড়কে সমভূমি করে দিতে হবে—এইতে পড়ল আমার প্রথম দৃষ্টি। সঙ্গে সঙ্গে চোখে লাগল শুধু শরীরগত দৌর্বল্য হটালে হবে না, বাঙালীর মন থেকে ভীরুতা অপসারিত করতে হবে। দেখা যায়, পশ্চিম ও পঞ্জাবের বড় বড় পালোয়ানেরাও সাহেব-ভীতিতে ভরা। এই সাদা চামড়ার ভয় সরাতে হবে।

 তাই ডমরুতে একটা ঘা দিয়ে রুদ্রের বীণা বাজল তৃতীয় তারে ঝঙ্কার দিয়ে আমার হাতে—‘বিলিতি ঘুষি বনাম দেশী কিল’ এই রাগে। ভারতীর পৃষ্ঠায় আমন্ত্রণ করলুম—রেলেতে স্টীমারে, পথে-ঘাটে, যেখানে সেখানে গোরা-সৈনিক বা সিভিলিয়ানদের হাতে স্ত্রী, ভগ্নী, কন্যা বা নিজের অপমানে মুহ্যমান হয়ে আদালতে নালিশের আশ্রয় না নিয়ে—অপমানিত ক্ষুব্ধ মানী ব্যক্তি স্বহস্তে তখনি তখনি অপমানের প্রতিকার নিয়েছে—সেই সকল ইতিবৃত্তের ধারাবাহিক বর্ণনা পাঠাতে। তাঁরা পাঠালেন ও তাঁদের ইতিবৃত্ত ভারতীতে বেরতে থাকল। পাঠকমণ্ডলীর মনে লুকান আগুন ধুঁকিয়ে ধুঁকিয়ে জ্বলে উঠল প্রবল তেজে। কোথা দিয়ে কোন্‌ হাওয়া বইছে, হঠাৎ যেন কেউ ঠাহর করে উঠতে পারে না। যে সাহিত্যের আঙ্গিনা ছিল কোমল আস্তরণ পাতা কমলালয়া সরস্বতীর নিকুঞ্জ, তা হল শ্মশানবাসী রুদ্রের ভীম নর্তনভূমি, আর তার তালে

১২৬