পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

স্ব-নিয়োজিত সদার। একদিন সর্দারি করে বললেন,—“তোর চুল বড্ড বড় হয়েছে, আয় ছেঁটে দিই।” কোথা থেকে একটা বড় কাঁচি সংগ্রহ করে কচ্ কচ্ করে আমার মাথা-ভরা কোঁকড়া চুল কাটতে লাগলেন। উবরো-খুবরো যেমন-তেমন করে, মাথা প্রায় ন্যাড়া করে কাটা হল চুল। মা-বাবা বাড়ি ছিলেন না, ফিরে এসে যেমনি আমার চুলের দিকে দৃষ্টি পড়ল, বাবামশায় ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন—মা-ও তাতে অমত করলেন না “আজ থেকে সাত দিন পর্যন্ত তোমার বাইরে যাওয়া বা বাড়িতে কেউ এলে তাদের সামনে বেরন বন্ধ। এমনি চুল নিয়ে লোকের সামনে বেরলে লোকে হাসবে।”

 শিশু, আমি লোকের হাসির মর্মান্তিকতা কিছু বুঝলাম না, কিন্তু একটি অবিচারবোধের তীব্র শেল আমার বুকের তলায় তলায় বিঁধতে লাগল। দিদি, যিনি আমার চুল বিশ্রী করে কাটলেন, আসল দোষ করলেন যিনি, তাঁর কোন শাস্তিই হল না। তিনি আগেকারই মত দিব্যি ফিটফাট হয়ে বুক ফুলিয়ে রোজ বিকেলে দাসীদের হাত ধরে হাওয়া খেতে যেতে লাগলেন। দাদাও তাঁর সঙ্গী হলেন—যদিও মা-বাবার বিনা অনুমতিতে দাদাও তাঁর চুলটা দিদির হাতে সমর্পণ করেছিলেন, দাদারও মাথায় দিদির হাতের কারিগরির নমুনা কিছু কিছু পরিদৃশ্যমান হয়েছিল। কিন্তু ব্যাটাছেলে তিনি, তাঁর চুল একটু-আধটু খারাপ দেখানতে আসে যায় না বোধ হয়, মেয়েদেরই শ্রীশালীনতার দিকে দৃষ্টি রাখার দরকার। তাই তিনজনের দোষের জন্য আমি একাই দায়ী হলুম। সাত দিন ধরে একলাটি ছাদের উপর একটা ঘরে আবদ্ধ রইলুম-একলা একলা সঙ্গিহীন, কাঁদিকাটি, কি করি সে আমিই জানি।

 দিদি প্রথম সন্তান বলে মা-বাবার আদুরে মেয়ে, দাদা প্রথম পুত্র বলে আদুরে, আমি আর একটি অধিকন্তু অপ্রার্থিত মেয়ে মাত্র। তাই বৈদিক ঋষিকুমার শুনঃশেফের মত আমার জীবনের পৃষ্ঠপটে (background-এ) একটা অনাদরের পরদা টানা। সে পরদাখানা উঠে গেল অল্পে অল্পে শুনঃশেফেরই মত বাইরের সংস্পর্শে।

 শাসনে শাসনেই গড়ে উঠেছি আমি, আদরে স্নেহে নয়। কিন্তু সিমলে বাড়ির সঙ্গে শাসনাতিরিক্ত একটি সরস স্মৃতিও জড়িত আছে—সেটি আমাদের পিতামহ জয়চন্দ্র ঘোষালের স্মৃতি। বলেছি তিনি একজন প্রবল-প্রতাপী পল্লী-জমিদার। যখনই আসতেন আমাদের বাড়িতে, পাড়াগাঁয়ের একটা নূতন হাওয়া নিয়ে আসতেন। তাঁর আগমন