পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বলিলেন। তা, আমার আর এখানে থাকিয়া আবশ্যক নাই, তুমি আমাকে বাপের বাড়ী পাঠাইয়া দাও। দিয়া, দুই রাণী নিয়ে সুখে-স্বচ্ছন্দে ঘরকন্না কর। আমি তোমার কণ্টক হইয়াছি, আমি এখান হইতে যাই।”

 মশা জিজ্ঞাসা করিলেন,— “সে মানুষের কন্যাটি কোথায়?”

 রক্তবতীর মা বলিলেন,— “ঐ বাহিরে বসিয়া আছে।”

 রক্তবতী বলিলেন,— “বাবা! তুমি আমার সঙ্গে এস। আমার পচাজল কোথায়, আমি এখনি দেখাইয়া দিব।”

 মশা ও রক্তবতী দুইজনে উড়িলেন। বিষন্নবদনে, অশ্রুপুরিতনয়নে, যেখানে কঙ্কাবতী বসিয়াছিলেন, গুনগুন করিয়া দুইজনে সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

 রক্তবতী বলিলেন,— “পচাজল। এই দেখ, বাবা আসিয়াছেন।”

 কঙ্কাবতী সসন্ত্রমে গাত্রোত্থান করিয়া মশাকে নমস্কার করিলেন। কঙ্কাবতীকে ভাল করিয়া দেখিতে পাইবেন বলিয়া, মশা গিয়া একটি ঘাসের ডগার উপর বসিলেন। তাহার পাশে আর একটি ঘাসের ডগার উপর রক্তবতী বসিলেন। মশার সম্মুখে হাতযোড় করিয়া কঙ্কাবতী দণ্ডায়মান রহিলেন।

 অতি বিনীতভাবে কঙ্কাবতী বলিলেন,— “মহাশয়! বিপন্ন অনাথা বালিকা আমি। জনশূন্য এই গহন কাননে আমি একাকিনী, আমি পতিহারা সতী। আমি দুঃখিনী কঙ্কাবতী। প্রাণসম পতি আমার ভূতিনীর হস্তগত হইয়াছেন। আমার পতিকে উদ্ধার করিয়া দিন। আমি আপনার শরণ লইলাম।”

 মশা জিজ্ঞাসা করিলেন,— “তুমি কাহার সম্পত্তি।

 কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন,— “মহাশয়! পূর্ব্বে আমি পিতার সম্পত্তি ছিলাম। বাল্যকালে বিক্রয়ের অধিকার পিতার থাকে। অন্ধ, আতুর, বৃদ্ধ, ব্যাধিগ্রস্ত—যাহাকে ইচ্ছা তাহাকেই তিনি দান-বিক্রয় করিতে পারেন। জ্ঞান না হইতে হইতে মাতাপিতা আপন আপন বালিকাদিগকে দান-বিক্রয় করিয়া নিশ্চিন্ত হন। আমাদের মধ্যে এই রীতি প্রচলিত। আমার পিতা, তিন সহস্ৰ স্বর্ণমুদ্রা লইয়া, আমাকে আমার পতির নিকট বিক্রয় করিয়াছেন। এক্ষণে আমি আমার পতির সম্পত্তি, যে পতিকে হারাইয়া অনাথা হইয়া আজ আমি বনে বনে কাঁদিয়া বেড়াইতেছি। পূর্ব্বে পিতার সম্পত্তি ছিলাম, এক্ষণে আমি আমার পতির সম্পত্তি!”

 মশা বলিলেন,— “উহু! সে কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি না। তুমি কোন মশার সম্পত্তি?”

 কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন— “কোন মশার সম্পত্তি। সে কথা ত’ আমি কিছু জানি না। কৈ? আমি তো কোন মশার সম্পত্তি নই!”

 মশা বলিলেন,— “রক্তবতী! তোমার পচাজল দেখিতেছি পাগলিনী, উন্মত্তা; ইহার কোনও জ্ঞান নাই। সঠিক সত্য সত্য কথার উত্তর না পাইলে তোমার পচাজলের কি করিয়া আমি উপকার করি?”

 রক্তবতী বলিলেন,— “ভাই পচাজল বাবা যে কথা জিজ্ঞাসা করেন, সত্য সত্য তাহার উত্তর দাও।”

 মশা বলিলেন,— “শুন, মনুষ্য-শাবক। এই ভারতে যত নর-নারী দেখিতে পাও, ইহারা সকলেই মশাদিগের সম্পত্তি। যে মশা মহাশয় তোমার অধিকারী, তাহার নিকট হইতে বোধ হয়, তুমি পলাইয়া আসিয়াছ। সেই ভয়ে তুমি আমার নিকট সত্যকথা বলিতেছ না, আমার

কঙ্কাবতী
৯৭