পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তৃতীয় অধ্যায়

একালের মেয়ে

এককড়ি দরিদ্র ব্রাহ্মণ। মেটে বাড়ী। অন্দরা-মহল সদর-বাড়ী সব এক। এককড়ির পরিবারবর্গ সকলেই নিধিরামের পীড়িতাবস্থায় সেবা-শুশ্রষা করিয়াছিলেন। হিরণ্ময়ী তাঁহার সহিত কথা কহিতেন। সেই দিন একটু অবসর পাইয়া নিধিরাম হিরণ্ময়ীকে বলিলেন,— “হিরণ্ময়ী! তোমাকে বিবাহ করিবার নিমিত্ত তোমার পিতা আমাকে অনুরোধ করিতেছেন। তুমি এক্ষণে বালিকা নও। আমি যাহা বলি, তাহা তুমি বুঝিতে পরিবে। আমার বয়স হইয়াছে। আমাকে বিবাহ করিলে তুমি সুখী হইবে না। বৃদ্ধ স্বামী হইয়াছে বলিয়া চিরকাল তুমি দুঃখ করিবে। আমার সেই বড় ভয় হইতেছে। কি করি বল দেখি?”

 হিরণ্ময়ী ঘাড় হেঁট করিয়া রহিলেন, চুপ করিয়া রহিলেন; একটিও কথা কহিলেন না। নিধিরাম পুনরায় বলিলেন,— “কি করি বল না? তুমি যাহা বলিবে, তাঁহাই হইবে। তুমি কিছু না বলিলে কালি আমি এখান হইতে চলিয়া যাইব।”

 হিরণ্ময়ী কাঁদিতে লাগিলেন। নিধিরাম বলিলেন,— “কঁদিও না, কান্না কিসের? বৃদ্ধ স্বামী হইবে বলিয়া কঁদিতেছ? তা, আমি তোমার ব্যাপকে বুঝাইয়া বলিব। আমার সহিত তোমার বিবাহ দিবার কথা আর তিনি উত্থাপন করিবেন না।”

 হিরণ্ময়ী আস্তে আস্তে বলিলেন,— “আপনি বৃদ্ধ বলিয়া কাঁদি নাই, আপনি চলিয়া যাইবেন, তাই কঁদিতেছি। আপনি তো বৃদ্ধ নন, 'বৃদ্ধ, বৃদ্ধ কেন বলিতেছেন?”

 নিধিরাম বললেন,— “তবে আমাকে বিবাহ করিতে তোমার অমত নাই? তুমি সুখী হইবে? তুমি আমাকে ভক্তি করিবে? তুমি আমাকে ভালোবাসিবে?”

 হিরণ্ময়ী আস্তে আস্তে বলিলেন,— “নিশ্চয়।”

 নিধিরাম বলিলেন,— “সত্য?”

 হিরণ্ময়ী বলিলেন,— “সত্য।”

 নিধিরাম বলিলেন,— “ঠিক?”

 হিরণ্ময়ী বলিলেন,— “ঠিক।”

 নিধিরাম বলিলেন,— “দেখ, দুই দিন পরে আমার চুল পাকিয়া যাইবে, দাঁত পড়িয়া যাইবে, আমি কদাকার বৃদ্ধ হইয়া যাইব। তখন তো তুমি আমাকে ঘৃণা করিবে না? তখনও তো ভক্তি করিবে, ভালোবাসিবে?”

 হিরণ্ময়ী বলিলেন,— “নিশ্চয়। আপনি বৃদ্ধ হইবেন, আর আমি কি চিরকাল এইরূপ থাকিব?”

 নিধিরাম বলিলেন,— “দেখ হিরণ্ময়ি! তোমাকে দেখিয়াই আমি তোমার রূপে মোহিত হইয়াছিলাম। এরূপ বয়সে তোমার মত সুরূপা বালিকাকে বিবাহ করা উচিত নয় বলিয়া আমি এস্থান হইতে এত সত্বর প্রস্থান করিতেছিলাম। তোমাকে বড় ভালবাসি। এ-বয়সে আমাদের মনে যে কোনও ভাব অঙ্কিত হইয়া যায়, তাহা আর মুছিয়া ফেলিবার যো নাই। কিন্তু তোমাদের চিত্ত এখন অন্যরূপ। তোমাদের চিত্ত এখন চঞ্চল। আজ তোমাদের মন একরূপ, কাল অন্যরূপ। আমার সেই বড় ভয়।”

ভূত ও মানুষ
১৩৯