পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তোমাকে কেন এ দুঃখে পড়িতে দিব? এই মনে করিয়া তোমাকে এ সংসারে টাকা খরচ করিতে মানা করিয়াছিলাম। আমি তখন ভাবি নাই, তুমি কিরূপ পিতার পুত্র। খেতু! অধিক আর তোমাকে কি বলিব, এই পৃথিবীতে তিনি সাক্ষাৎ দেবতাস্বরূপ ছিলেন। তোমাকে আশীর্ব্বাদ করি, তাই! যেন তুমি সেই দেবতুল্য হও।”

 রামহরির চক্ষু দিয়া ফোঁটায় ফোঁটায় জল পড়িতে লাগিল। রামহরির স্ত্রীও চক্ষু পুছিতে লাগিলেন। খেতুরও চক্ষু ছলছল করিয়া আসিল।

 খেতু তিনটা পাস দিলেন, আর কন্যাভারগ্রস্ত লোকেরা রামহরির নিকট আনাগোনা করিতে লাগিলেন। সকলের ইচ্ছা খেতুর সহিত কন্যার বিবাহ দেন। ইনি বলেন,— “আমি এত সোনা দিব, এত টাকা দিব।” তিনি বলেন,— “আমি এত দিব, তত দিব।” এইরূপে সকলে নিলামডাকাডাকি করিতে লাগিলেন।

 রামহরি সকলকে বুঝাইয়া বলিলেন যে, যত দিন না খেতুর লেখাপড়া সমাপ্ত হয়, যতদিন না খেতু দু’পয়সা উপাৰ্জ্জন করিতে পারে, ততদিন তিনি খেতুর বিবাহ দিবেন না।

 কিন্তু কন্যাভারগ্রস্ত লোকেরা সে কথা শুনিবেন কেন? রামহরির নিকট তাহারা নানারূপ মিনতি করিতে লাগিলেন। অবশেষে রামহরি মনে করিলেন,— “দূর হউক! এক স্থানে কথা দিয়া রাখি। তাহা হইলে সকলে আর আমাকে এরূপ ব্যস্ত করিবে না।”

 এই মনে করিয়া তিনি অনেকগুলি কন্যা দেখিলেন। শেষে জন্মেজয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যাকে তিনি মনোনীত করিলেন। জন্মেজয়বাবু সঙ্গতিপন্ন লোক ও সদ্বংশজাত। রামহরি কিন্তু তাঁহাকে সঠিক কথা দিতে পারলেন না। খেতুর মা'র মত না লইয়া কি করিয়া তিনি কথা স্থির করেন?


একাদশ পরিচ্ছেদ

সম্বন্ধ

কঙ্কাবতীর যত বয়স হইতে লাগিল, ততই তাঁহার রূপ বাড়িতে লাগিল। কঙ্কাবতীর রূপে দশদিক আলো, কঙ্কাবতীর পানে চাওয়া যায় না। রংটি উজ্জ্বল ধবধবে, ভিতর হইতে যেন জ্যোতিঃ বাহির হইতেছে, জল খাইলে যেন জল দেখা যায়। শরীরটি স্থূলও নয়, কৃশও নয়, যেন পুতুলটি, কি ছবিখানি। মুখখানি যেন বিধাতা কুদে কাটিয়াছেন। নাকটি টিকোলোটিকোলো, চক্ষু দুটি টানা, চক্ষুর পাতা দীর্ঘ, ঘন ও ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। চক্ষু কিঞ্চিৎ নীচে করিলে পাতার উপর পাতা পড়িয়া এক অদ্ভুত শোভার আবির্ভাব হয়। এইরূপ চক্ষু দুইটির উপর যেরূপ সরু সরু কালো কালো, ঘন ভুরুতে মানায়, কঙ্কাবতীর তাঁহাই ছিল। গাল দুটি নিতান্ত পূর্ণ নহে, কিন্তু হাসিলে টোল পড়ে। তখন সেই হাসিমাখা টোল-খাওয়া মুখখানি দেখিলে শত্রুর মনও মুগ্ধ হয়। ঠোঁট দুটি পাতলা। পান খাইতে হয় না, আপনা-আপনি সদাই টুকটুক করে। কথা কহিবার সময় ঠোঁটের ভিতর দিয়া, সাদা দুধের মত দুই-চারিটি দাঁত দেখিতে পাওয়া যায়, তখন দাঁতগুলি যেন ঝকঝক করিতে থাকে। কঙ্কাবতীর খুব চুল, ঘোর কালো, ছাড়িয়া দিলে, কোঁকড়া কোঁকড়া হইয়া পিঠের উপর গিয়া পড়ে। সম্মুখের সিঁথিটি কে যেন তুলি দিয়া ঈষৎ সাদা রেখা টানিয়া দিয়াছে। স্থূলকথা, কঙ্কাবতী একটি প্রকৃত সুন্দরী, পথের

২৬
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ