পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সম্মুখে সর্ব্বদাই প্রত্যক্ষ দেখিব, ক-দিন বাকী রহিল।”

 কঙ্কাবতী ভাবিলেন যে,— “দেশে যাইবার নিমিত্ত স্বামীর মন বড়ই আকুল হইয়াছে। প্রাচীরে তো দশটি দাগ দিলাম, যেমন এক একটি দিন যাইবে, তেমনি এক একটি দাগ তো মুছিয়া ফেলিলাম; তা তো সব হইবে। কিন্তু একদিনেই কি দশটি দিন মুছিয়া ফেলিতে পারি না? একদিনেই কি স্বামীর উদ্ধার করিতে পারি না? বাবা যা বলিয়া দিয়াছেন, তাই করিয়া দেখিলে তো হয়! আজি কি কাল যদি দেশে যাইতে পান, তাহা হইলে আমার স্বামীর মনে কতই না আনন্দ হইবে!”

 এই দুই মাসের মধ্যে, পিতার কথা তাঁহার অনেক বার স্মরণ হইয়াছিল। মন্দলোকে তাহার স্বামীকে গুণ করিয়াছে এই চিন্তা তাহার মনে বারবার উদয় হইয়াছিল। তবে মা বারণ করিয়া দিয়াছিলেন, সেজন্য এতদিন তিনি কোনওরূপ প্রতিকারের চেষ্টা করেন নাই। এক্ষণে দেশে যাইবার নিমিত্ত স্বামীর ঘোরতর ব্যগ্রতা দেখিয়া কঙ্কাবতীর মন নিতান্ত অস্থির হইয়া পড়িল।

 কঙ্কাবতী ভাবিলেন,— “বাবা পুরুষমানুষ! পাহাড়-পর্ব্বত বন-জঙ্গল, বাঘ-ভালুক, শিকড়-মাকড় তন্ত্র-মন্ত্র, এ সকলের কথা বাবা যত জানেন, মা তত কি করিয়া জানিবেন? মা, মেয়েমানুষ, ঘরের বাহিরে যান না। মা কি করিয়া জানিবেন যে, লোকে শিকড় দিয়া মন্দ করিলে, তাহার কি উপায় করিতে হয়? শিকড়টি দগ্ধ করিয়া ফেলিলেই সকল বিপদ কাটিয়া যায়, বাবা এই কথা বলিয়াছেন। এখনও দশ দিন আছে, স্বামী আমার দিন গণিতেছেন। যদি কা’ল তিনি বাড়ী যাইতে পান, তাহা হইলে ত কত না আনন্দ হইবে।”

 এইরূপ কল্পাবতী সমস্তদিন ভাবিতে লাগিলেন, একবার মনে ভাবেন,— “কি জানি, পাছে ভাল করিতে গিয়া মন্দ হয়! কাজ নাই, দশটা দিন চক্ষু-কর্ণ বুজিয়া চুপ করিয়া থাকি। বাবা যাহা করিতে বলিয়াছেন, মা তাহা বারণ করিয়াছেন।”

 স্বামীকে আমি মুক্ত করিব। আমি যদি স্বামীকে মুক্ত করিতে পারি, তাহা হইলে তিনি কত না আমার উপর পরিতুষ্ট হইবেন।”

 ভাবিতে ভাবিতে সমস্তদিন চলিয়া গেল। কি করিবেন, কঙ্কাবতী কিছু স্থির করিতে পারিলেন না। রাত্রিতেও কঙ্কাবতী এই চিন্তা করিতে লাগিলেন। তিলকসুন্দরী ও ভুশকুমড়োর গল্প মনে পড়িল।

 রাজপুত্র, তিলকসুন্দরীর রূপে মুগ্ধ হইয়াছিলেন। তিলকসুন্দরীকে বিবাহ করিবার নিমিত্ত তাঁহার মন হইয়াছিল। তিলকসুন্দরীর সৎমা তাহার মাথায় একটি শিকড় দিয়া দিলেন। শিকড়ের গুণে তিলকসুন্দরী পক্ষী হইয়া গেল। উড়িয়া গিয়া গাছের ডালে বসিল। সৎমা কৌশল করিয়া আপনার কন্যা ভুশকুমড়োর সহিত রাজপুত্রের বিবাহ দিলেন। ভুশকুমড়োকে রাজপুত্র আদর করিতে লাগিলেন। তাহা দেখিয়া তিলকসুন্দরী গাছের ডাল হইতে বলিল,— “ভুশকুমড়ো কোলে! তিলকসুন্দরী ডালে!” রাজপুত্র মনে করিলেন,— “পাখীটি কি বলে?” রাজপুত্র সেই পাখীটিকে ডাকিলেন। পাখীটি আসিয়া রাজপুত্রের হাতে বসিল। সুন্দর পাখীটি দেখিয়া, রাজপুত্র তাহার মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলেন। হাত বুলাইতে বুলাইতে মাথার শিকড়টি পড়িয়া গেল। পাখী তখন পুনরায় তিলকসুন্দরী হইল। রাজপুত্র তখন সৎমার দুষ্টাভিসন্ধি বুঝিতে পারিলেন। সৎমার কন্যা ভূশকুমড়োকে হেঁটে কাঁটা, উপরে কঁটা দিয়া পুঁতিয়া ফেলিলেন। তিলকসুন্দরীকে লইয়া সুখে ঘরকন্না করিতে লাগিলেন।

কঙ্কাবতী
৬৯