কথা কহিলেন, ষোড়শীকে উদ্দেশ করিয়া অতিশয় সাধুভাষায় তাঁহাদের অভিমত ব্যক্ত করিয়া বলিলেন, আজ হৈমবতী তাঁর পুত্রের কল্যাণে যে পূজা দিতেছেন, তাতে তোমার কোন অধিকার থাকিবে না, তাঁর এই সঙ্কল্প তিনি আমাদের জানিয়েছেন। তাঁর আশঙ্কা, তোমাকে দিয়ে তাঁর কার্য সুসিদ্ধ হবে না।
ষোড়শীর মুখ একেবারে পাণ্ডুর হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু তাহার গলায় জড়িমা ছিল না। কহিল, বেশ। তাঁর কাজ যাতে সুসিদ্ধ হয় তিনি তাই করন।
তাহার এই কণ্ঠস্বরের সুস্পষ্টতায় সর্বেশ্বর শিরোমণি নিজের গলাতেও যেন জোর পাইলেন, বলিলেন, কেবল এইটুকুই ত নয়! আমরা গ্রামস্থ ভদ্রমণ্ডলী আজ স্থিরসিদ্ধান্তে উপস্থিত হয়েছি যে, দেবীর কাজ আর তোমাকে দিয়ে হবে না। মায়ের ভৈরবী তোমাকে রাখলে আর চলবে না। কে আছ, একবার তারাদাস ঠাকুরকে তাক ত?
একজন তাহাকে ডাকিতে গেল। ষোড়শীর মুখে যে প্রত্যুত্তর আসিয়াছিল, তাহার পিতার নামে সেইখানেই তাহা বাধিয়া গেল, সে মুখ তুলিয়া হঠাৎ বলিয়া ফেলিল, কেন চলবে না? কিন্তু বলিয়া ফেলিয়া সে নিজেই যেন চমকিয়া গেল।
ভিড়ের মধ্য হইতে কে একজন কহিল, সে তোমার বাবার মুখেই শুনতে পাবে।
ষোড়শী এ কথার আর কোন উত্তর দিল না, চাহিয়া দেখিল, তাহার পিতা কে-একটি বছর-দশেকের মেয়েকে সঙ্গে করিয়া আসিতেছে, এবং তাহাদের পশ্চাতে আর একটি বয়স্থা শ্রীলোক সঙ্গে সঙ্গে আসিতেছে। ইঁহাদের কাহাকেও ষোড়শী পূর্বে দেখে নাই, তথাপি বুঝিল উনিই পিসী এবং এই মেয়েটিই সেই অচেনা পিসির কন্যা।
এ-সমস্তই যে রায়মহাশয়ের কৃপায়, তাহা ভিতরে ভিতরে সকলেই জানিত, ষোড়শীরও অজানিত নয়। রায়মহাশয় নীরব থাকিলেও তাঁহার চোখের উৎসাহ পাইয়াও তারাদাস প্রথম কথা কহিতে পারিল না, পরে জড়াইয়া জড়াইয়া যাহা কহিল, তাহারও অধিকাংশ স্পষ্ট হইল না, কেবল একটা কাজের কথা বুঝা গেল যে জেলার ম্যাজিস্ট্রেটসাহেব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়াছেন, এবং ইহাকে সেবায়েত হইতে অপসারিত না করিলে ভাল হইবে না।
ইহাই যথেষ্ট! একটা কলরব উঠিল, অনেকেই রায় দিলেন যে এতবড় গুরুতর ব্যাপারে কাহারও কোন আপত্তি খাটিতে পারে না। পারে না তাহা ঠিক। যাঁহারা চুপ করিয়া রহিলেন তাঁহারাও এই সত্যটাই মানিয়া লইলেন। কারণ, কেন পারে না, এমন প্রশ্ন করিবার মত দুঃসাহস কাহারও ছিল না। অথচ আশ্চর্য এই যে, ঠিক তাহাই ঘটিল। কোলাহল থামিলে শিরোমণি এই নিষ্পত্তিটাই বোধ হয় আর একটু ফলাও করিতে যাইতেছিলেন, সহসা একটি মৃদু কণ্ঠস্বর শোনা গেল―বাবা?
সবাই মুখ তুলিয়া চাহিল। রায়মহাশয় নিজেও মুখ তুলিয়া এদিকে ওদিকে চাহিয়া পরিশেষে কন্যার কণ্ঠস্বর চিনিতে পারিয়া সস্নেহে সাড়া দিলেন, কেন মা?
হৈম মুখখানি আরও একটু বাড়াইয়া কহিল, আচ্ছা বাবা, সাহেব যে রাগ করেচেন, এ কি করে জানা গেল?
৩৯