পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আপনার মেয়ে হয়ত বিশ্বাস করবে না রায়মশাই? ও-ই বলুক। চণ্ডীর দিকে মুখ করে ওই নিজের মায়ের কথা নিজেই বলে যাক। কি বলেন চৌধুরীমশাই? তুমি কি বল হে যোগেন ভট্‌চায? কেমন, ওই নিজেই বলুক!

 গ্রামের এই দুই দিক্‌পালের সাংঘাতিক অভিযোগে উপস্থিত সকলেই যেন বিভ্রান্ত হইয়া উঠিল। ষোড়শীর পাণ্ডুর ওষ্ঠাধর কি একটা বলিবার চেষ্টায় বারংবার কাঁপিতে লাগিল, মুহূর্ত পরে হয়ত সে কি একটা বলিয়াও ফেলিত, কিন্তু হৈম দ্রুতপদে তাহার কাছে আসিয়া হাতটা ধরিয়া ফেলিয়া শান্ত দৃঢ়স্বরে বলিল, না, আপনি কিছুতেই কোন কথা বলবেন না। পিতার মুখের প্রতি তীব্র দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, আপনারা ওঁর বিচার করতে চান নিজেরই করুন, কিন্তু ওঁর মায়ের কথা ওর নিজের মুখ দিয়ে কবুল করিয়ে নেবেন, এতবড় অন্যায় আমি কোনমতে হতে দেব না। ওঁরা যা পারেন করুন, চলুন আপনি আমার সঙ্গে মন্দিরের মধ্যে। বলিয়া সে আর কোনদিকে লক্ষ্য না করিয়া ষোড়শীকে একপ্রকার জোর করিয়াই সম্মুখের দিকে ঠেলিয়া লইয়া চলিল।

আট

 মন্দিরের অভ্যন্তরে একপাশে স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া ষোড়শী কহিল, না বোন, আমি পূজো করব না।

 কেন? বলিয়া হৈম সবিস্ময়ে চাহিয়া দেখিল, ভৈরবীর মুখ ম্লান, কোনরূপ আনন্দ বা উৎসাহের লেশমাত্র নাই এবং তাহার প্রশ্নের উত্তর সে যেন একটু চিন্তা করিয়া দিল। কহিল, এর কারণ যদি কখনো বলবার দরকার হয়, সে শুধু তোমাকেই বলব, কিন্তু আজ নয়। তা ছাড়া আমি নিজেও বড়-একটা পূজা করিনে ভাই, যিনি এ কাজ নিত্য করেন তিনিই করুন, আমি কেবল এইখানেই দাঁড়িয়ে তোমার ছেলেকে আশীর্বাদ করি, সে যেন দীর্ঘজীবি হয়, নীরোগ হয়, মানুষ হয়।

 সন্তানের প্রতি ভৈরবীর এই ঐকান্তিক আশীর্বচনেও মায়ের মন হইতে অপ্রসন্নতা ঘুচিল না। সে কুণ্ঠিতস্বরে কহিল, কিন্তু আজকের দিনটা যে একটু অন্যরকমের দিদি! আপনি নিজের হাতে পূজো না করলে যে ওঁদের কাছে ভারী ছোট হয়ে যাবো! বলিয়া সে একবাব উন্মুক্ত দ্বার দিয়া বাহিরের বিক্ষুব্ধ জনতার প্রতি দৃষ্টিপাত করিল।

 ষোড়শীর নিজের দৃষ্টিও উহাকে অনুসরণ না করিয়া পারিল না। দেখিল সকলে এই দিকেই চাহিয়া আছে। তাহাদের চোখ ও মুখের উপর উৎকট কলহের চিহ্ন একান্ত চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে―ঠিক যেন অধীর সৈনিকের দল কেবলমাত্র তাহাদের অধিপতির ইঙ্গিতের অপেক্ষায় বহু দুঃখে তাহাদের যুদ্ধ-বেগ সংযত করিয়া আছে। কিন্তু রায়মহাশয় সে ইঙ্গিত দিলেন না। তিনি ঘোর সংসারী লোক, মুহূর্তেই

৪১