পাতা:নরওয়ে ভ্রমণ.pdf/১০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
নরওয়ে ভ্রমণ।
৯৩

 এবারে এই উৎসব ক্ষেত্র হইতে বিদায় গ্রহণেচ্ছু হইয়া আমাদের বাস্পীয় শকটের আশ্রয় লইলাম। কিন্তু আমাদের অভিভাবিকা আমাদিগকে নিজ আবাসে পৌছিয়া না দিয়া তাঁহার বসতবাটীতে লইয়া চলিলেন। তাঁহার আদেশমত একটি সপ্ততল গৃহের সম্মুখে আসিয়া আমাদের গাড়ী থামিল। পুনঃ অবতরণ এবং lift এ অধিরোহণ। ইহাতে ঘণ্টাধ্বনিদ্বারা কাহাকেও ডাকিয়া আনা আবশ্যক হইল না বা দ্বারদেশে কাহাকেও দণ্ডায়মান দেখিলাম না। গৃহকর্ত্রী স্বয়ংই কল টিপিয়া আমাদগিকে উর্দ্ধগামী করিয়া লইয়া চলিলেন এবং নিমেষ মধ্যেই নির্দ্দিষ্ট তলে স্বতঃই আমাদিগের lift স্থগিত হইবামাত্র স্বতঃই তাহার দ্বার উদঘাটিত হইল এবং আমরা এক অতি পরিপাটী প্রকোষ্ঠে আসিয়া উপবেশন করিলাম। তখন সেই বিদুষী আমাদিগকে কৌতূহলী দেখিয়া আপনা হইতেই বললেন যে আজ বিশ বৎসর যাবৎ তিনি একাকী এই গৃহমধ্যে বাস করেন। এমন কি কোন পরিচারিকাকেও রাত্রিতে এখানে রাখা হয় না। তাহারা দিনের কার্য্য সমাপ্ত করিয়া নিয়মিত সময়ে সকলেই চলিয়া যায়। তখন জিজ্ঞাসা করিলাম, “ভদ্রে! তুমি যদি দৈবাৎ রজনীতে পীড়াগ্রস্ত হও তবে কি প্রতিবিধান কর?” মৃদুমন্দ হাস্য করিয়া উত্তর করিলেন, “চিকিৎসক এবং পরিচারিকাকে ডাকাইবার জন্য আমার শয্যাপার্শ্বে তারযোগে সংবাদ দেবার ব্যবস্থা আছে সুতরাং কাহাকেও প্রহরী রাখা আবশ্যক মনে করি না।” ঘরের অস‍্বাব্, দেখিয়া মনে হইল ইনি বেশ অবস্থাপন্ন লোক; অথচ এদেশে কি চুরী ডাকাতির ভয় নাই? কি জানি! তিনি কি কারণে চিরকৌমার্য অবলম্বন করিয়াছেন কি নিমিত্তই বা একাকী বাস করেন ভদ্রতার অনুরোধে এ সকল কূটপ্রশ্নের মীমাংসা করিতে সাহসে কুলাইল না। এবারকার মত তাঁহার সৎসঙ্গ ছাড়িয়া আমরা চলিয়া আসিলাম। কিন্তু হৃদয়ের মধ্যে সে সৌম্যমূর্ত্তি চিরদিনের তরে ঠাঁই নিল। জাহাজে ফিরতে রাত্রি হইল। আর একদিন পরেই এ প্রবাসযাত্রার অবসান হইবে ভাবিয়া অন্তরে বড়ই স্ফ‌ুর্ত্তি অনুভব করিলাম। বিশেষ একমাত্র সন্তান ছাড়িয়া বেশী দিন দূরে থাকা কষ্টসাধ্য হইয়া পড়িয়াছিল। মায়ের প্রাণ এবারে অকূলের সন্ধান ছাড়িয়া কূলের দিকে বাঁকিয়া পড়িল দেখিয়া, মহাসিন্ধু আপনার তরঙ্গ ভঙ্গে হাসির লহরী তুলিয়া, ক্ষুদ্র জননীকে উপহাস করিতে লাগিল। যদি সে আজ এ ক্ষীণ প্রাণকে তার বক্ষমাঝে লুকাইয়া রাখে, তবে কি সাধ্য আছে জননীর কূলের কিনারা পাইতে? তখন ভীত হইলাম, করযোড়ে বিপুল বারিধির বন্দনায় নিযুক্ত হইলাম!