পাতা:নরওয়ে ভ্রমণ.pdf/২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
নরওয়ে ভ্রমণ
১৩

প্রসূত সামান্য চিত্রের সহিত তুলনা করিয়া বলিয়া উঠে—“আহা! যেন ছবিখানি!” কিন্তু যে সুনিপুণ, নিত্য-নূতন-সৃষ্টিকুশল পুরুষ যাবতীয় অসামান্য মরচিত্রকরকে হাতে ধরিয়া আজীবন কলা-কৌশল শিক্ষা দিতেছেন, তাঁহার রচিত কারুকলার যথাসম্ভব অনুকরণ-সিদ্ধিতেই যাহাদের কৃতিত্বের চরম সার্থকতা,—তাহাদের সাধ্য কি যে তাহারা সেই সুমহান কারিগরের কারুকার্য্য নিজেদের সামান্য চিত্রফলকে ফলাইবে? আজ তিনি নিশ্চল শৈলসমূহে দণ্ডায়মান থাকিয়া, সন্তালবৎসল পিতার ন্যায়, এই স্নিগ্ধ সূর্য্যালোকে তাঁহার স্নেহদৃষ্টি বর্ষণ করিতে করিতে, প্রকৃতি-দেবীর পরিচর্য্যা গ্রহণ করিতেছেন। তাই আজ চারিদিকে কেবল সেবার আয়োজন। পিতৃচরণ ধৌত করিতে গিয়া ভক্ত-সন্তান জল-ধারায় ধরণীকে যেন প্লাবিত করিয়া ফেলিতেছে, তবু তৃপ্তি নাই। সারি সারি কেবলই ফুলের সাজি। এ পূজার আরম্ভও নাই শেষ ও নাই, নিত্য-নিয়ত অনাদিকাল ব্যাপিয়াই চলিয়াছে। আমার এ ক্ষুদ হৃদয় এত নিষ্ঠা বুঝতে না পারিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিল, আর ভাবিল, এই সভ্য পাশ্চাত্য দেশেও কি স্রক্‌চন্দনে পৌত্তলিক পূজার প্রথা প্রচলিত আছে! তাইত!— ইচ্ছা ছিল, ক্ষণকাল দাঁড়াইয়া এই নিঊঢ় ভক্তিতত্ত্বের কিছু সারসংগ্রহ করিয়া লইব, কিন্তু তাহা আর পারিলাম কৈ? নিয়মিত সময়ে কাজ করিবার সুখও আছে, দুঃখও অনেক! বিশেষ কুক্ কোম্পানীর হাতে পড়িলে, আমাদের ভাবপ্রবণ বাঙ্গালীরা যেন হাবুডুবু খাইতে থাকে। একেই ত ইহাদের মতে আমাদের সময়ের জ্ঞান আদৌ নই; তাতে যদি আবার চলা-ফিরাকার্য্যে একটু শিথিলতা দেখাই, তবে ত দেশ-দেখিবার সখে একেবারেই ইস্তফা দিতে হয়! এরা আর কি আমাদের উঠা-নাবার ভার লইবে? অগত্যা, মনের ক্ষোভ মনে চাপিয়া, ম্লানমুখে শকটারোহণে তৎপর হইলাম।—এইবার অবতরণ, অতএব অশ্বিনীনন্দনদেরও ত্বরিৎগতিতে গমন আরম্ভ হইল; কিন্তু প্রস্তর-বহুল পার্ব্বত্যপথে অপহরণ নিতান্ত নির্ব্বিঘ্ন নয়, কাজেই মাঝে মাঝে যেন প্রাণটা হাতে করিয়া থাকিতে হইয়াছিল। যখন আমরা সবেগে অধোগামী হইতেছিলাম, তখনকার নয়নাভিরাম শোভা দেখিয়া মহাকবি কালিদাসের উক্তি মনে পড়িয়া গেল—

“শৈলানামবরোহতীব শিখরাদুন্মজ্জতাং মেদিনী,
পর্ণাভ্যন্তরীনতাং বিজহতি স্কন্ধোদেয়াৎ পাদপাঃ।
সন্তনৈন্তভাবনষ্টসলিলা ব্যক্তিং ভজন্তাপগাঃ
কেনাপ্যুৎক্ষিপতেব পশ্য ভুবনং মৎপার্শ্বমানীয়তে।”