পাতা:নরওয়ে ভ্রমণ.pdf/৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭৮
নরওয়ে ভ্রমণ

এ কি কম কথা। কিন্তু অভ্যাহার-বিধির বিধান মানিয়া চলা আমাদের দেশের পদ্ধতি নয়। এজন্য খাদকেরা যত না দায়ী, খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত প্রণালীর প্রবর্ত্তকেরা তদপেক্ষা বেশী দায়ী নয় কি? আমাদের যত কিছু উপাদেয় সামগ্রী, প্রায় সকলই স্বাস্থ্যনাশের উমেদারী করে। কাজেই আমরা নাচার।

 সমুদ্রের তীরেই এই পান্থশালাটি প্রতিষ্ঠিত বলিয়া বড়ই মনোজ্ঞ হইয়াছে। জলনিধিতে নিমজ্জন সুখ-লালসায় স্ত্রী-পুরুষ-নির্ব্বিশেষে বিস্তর লোকের সমাগম দেখিলাম। গঙ্গার ঘাটে অহরহ এ ব্যাপার সংঘটিত হইয়া থাকে বটে, কিন্তু সে অবগাহনের উদ্দেশ্য স্বতন্ত্র বলিয়া, আমাদের সলজ্জ চক্ষুকে মোটেই পাড়িত করে না। পাশের ঘরে গীত-বাদ্যের চর্চা চলিতেছিল। গায়িকার সুমধুর কণ্ঠস্বরে যেন সে অট্টালিকা পুলকিত এবং তন্মধ্যস্থিত ভূত গ্রাম অঙ্গিভূত হইয়া পড়িতেছিল। ভাবিলাম, যার কণ্ঠে এত মধু ঝরে, সে না জানি কি রূপ ধরে? এ গলা কি ঈশ্বর-প্রদত্ত? না আধার গুণে সাধায় এতটা উৎকর্ষ প্রাপ্ত? কবিগণ বলিয়া গিয়াছেন “প্রকর্ষমধারবশংগুণানাম্”। সে যাহাই হউক, এটা যে বেশ উঁচুদরের গান (high-class singing”) তা’ত শ্রোতাদের ভাবগতি দেখিয়া স্পষ্টই প্রতীয়মান হইল। এস্থলে এইটুকু বলা আবশ্যক যে, পাশ্চাত্য high-class music or singing, দুই একবার বই শোনা ভাগ্যে ঘটে নাই বলিয়া আজ এ গানের রসাস্বাদনে সম্পূর্ণ অসমর্থ হইলাম।

 এ বিষয়ে পাকা সমজদার না হইলে, পাছে, অজ্ঞতনিবন্ধন অস্থানে অসামঞ্জস্য ভাবের প্রশ্রয় দিয়া হাস্যাস্পদ হইয়া পড়ি, সে আশঙ্কাও যথেষ্ট ছিল। আবার পরের হাসায় হাসা, বা পরের কাঁদায় কঁদিতে যাওয়া কম বিড়ম্বনা নয়। কি করি! যখন সে গানকর্ত্রীর সাক্ষাৎ দর্শন-লাভ হইল, তখন তথাকার শ্রোতৃবর্গের নিস্তব্ধ নিঃস্পন্দ ভাব দেখিয়া, অনুমান করিয়া লইলাম যে, সে কণ্ঠে তবে তৎকলাসম্ভ‌ুত বিশেষে কোন কার‍্দানি চলিতেছে; অতএব অবাক্ হইয়া স্থাণুবৎ দণ্ডায়মান থাকাই শ্রেয়ঃ। তারপর, গানশোনা শেষ করিয়া, পদব্রজেই আমরা সকলে, হেম‍্লেটের গোরস্থানের দিকে রওনা হইলাম। কুক্ কোম্পানীর প্রধান কর্মচারী স্বয়ং আমাদিগকে পথ দেখাইয়া চলিলেন। অমন স্থানে যাইতে হইলে, স্বভাবতই মনটা নম্র হইয়া আসে, ভবলীলার অনিত্যতা স্মরণে জাগে; মৃত্যুর মহিমায় আর বাহিরের আনন্দ-উল্লাসে মতি থাকে না।

 আমরা যে পথ ধরিয়া চলিলাম, তাহার দুই পাশেই সারিবাঁধা সরল বৃক্ষ সকল আকাশ আচ্ছন্ন করিয়া আছে। দিনটী বড়ই পরিস্কার ছিল। একটু পথ চলিতেই,