প্রায় অনুরূপ প্রথা দেখা যায়। ইহাতে লাভ এই হয় যে, এমন জাতি ধ্বংসের মুখেই অগ্রসর হইতে থাকে। ইতিমধ্যে অনুকূল কারণ না থাকিলে, গহন-বনে বা অতি নিভৃত পর্বত-কন্দরে সন্ততি-রক্ষার আশ্রয় না মিলিলে, আমরা বোধ করি এই পশুগুলোর নাম পর্যন্তও জানিতে পারিতাম না—তাহারা বহুপূর্বেই নিঃশেষ হইয়া যাইত। এই ঘটনাটা একটু প্রণিধান করিয়া দেখিলেই একটা আশ্চর্য আত্মঘাতী ব্যাপার চোখে পড়ে। এই পশু বংশবৃদ্ধির নৈসর্গিক তৃষ্ণা ও উত্তেজনার বশে লড়াই করিয়া প্রাণ দেয়, অথচ ইহারাই শেষ সফলতার দিকে একবার ফিরিয়াও দেখে না। তা ছাড়া আরো একটা কথা এই, যে জন্তুটা প্রাণ দেয়, সে নিজের অসহ্য প্রবৃত্তির যূপকাষ্ঠেই কণ্ঠচ্ছেদ করে, নারীর জন্য নারীর পদমূলে আত্মবিসর্জন করে না। অতএব মূল্য যদি এখানে কিছু থাকে ত সে তাহার নিজের প্রবৃত্তির, নারীর নয়। এই দুটো কথা মনে রাখিয়া, পশুর রাজ্য অতিক্রম করিয়া, মানুষের রাজ্যে পদার্পণ করিয়াও এই ব্যাপারের অসদ্ভাব ঘটে না, এবং আজ এই পাশব প্রবৃত্তিকে নিজেদের সমাজে যত ইচ্ছা বড় বলা হউক না কেন, এবং নর-নারীর স্বর্গীয় প্রেমের জন্মভূমি যত বড় স্বর্গে ই নির্দেশ করা থাক্ না কেন, তাহা সত্য নয়, নিছক কল্পনামাত্র। আমি গোটা-দুই খৃষ্টান্ত দিয়া তাহাই বলিতেছি। কিন্তু বলিবার পূর্বে এ-কথাটাও বিশেষ করিয়া বলিয়া রাখি যে, ক্রমোন্নতির ফলে নর-নারীর সহস্রমুখী স্নেহপ্রেমের যে মধুর চিত্র বাল্মীকির হৃদয়ে ব্যাসের হৃদয়ে, কালিদাসের হৃদয়ে উদ্ভূত হইয়া বিশ্বজগতে প্রতিবিম্বিত হইয়াছে, তাহা স্বর্গীয় বস্তু অপেক্ষা কোন অংশে হীন নয়। নীচ-কুলে জন্ম বলিয়া আর তাহাকে উপেক্ষা করা যায় না। কোহিনুরকে পাথুরে কয়লার খোঁটা দিয়া, উপনিষদের ব্রহ্মজ্ঞানকে ভূতের ভয়ের লজ্জা দিয়া, তাহার যথার্থ মূল্য হইতে তাহাকে বঞ্চিত করা কিছুতেই চলে না। এ-সকল আমি জানি এবং জানি বলিয়াই ইহার জন্মের কথা তুলিয়াছি, এবং ধীরে ধীরে এই মূল্য যে আজ যথার্থ কত বড় হইয়া উঠিয়াছে, তাহা মানবের
পাতা:নারীর মূল্য-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৪১
অবয়ব
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
নারীর মূল্য
৪০