পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ছাড়িয়া শক্ত ডাঙার উপরে গাড়ির মধ্যে বসিতে পাইয়া অপূর্ব্ব আরাম বোধ করিল। কিন্তু মিনিট-দশেকের মধ্যে গাড়ি যখন বাসার সম্মুখে আসিয়া থামিল, এবং দরোয়ানজী হাঁক-ডাকে প্রায় ডজনখানেক কৌরঙ্গদেশীয় কুলি যোগাড় করিয়া মোটঘাট উপরে তুলিবার আয়োজন করিল, তখন সেই তাহার ত্রিশ টাকা ভাড়ার বাটীর চেহারা দেখিয়া অপূর্ব্ব হতবুদ্ধি হইয়া রহিল। বাড়ির শ্রী নাই, ছাঁদ নাই, সদর নাই, অন্দর নাই, প্রাঙ্গণ বলিতে এই চলাচলের পথটা ছাড়া আর কোথাও কোন স্থান নাই। একটা অপ্রশস্ত কাঠের সিঁড়ি রাস্তা হইতে সোজা তেতালা পর্য্যন্ত উঠিয়া গিয়াছে, সেটা যেমন খাড়া তেমনি অন্ধকার। ইহা কাহারও নিজস্ব নহে, অন্ততঃ ছয়জন ভাড়াটিয়ার ইহাই চলাচলের সাধারণ পথ। এই উঠা-নামার কার্য্যে দৈবাৎ পা ফস্কালেই প্রথমে পথের বাঁধানো রাজায় রাজপথ, পরে তাঁহারই হাঁসপাতাল, এবং তৃতীয় গতিটা না ভাবাই ভালো। এই দুরারোহ দারুময় সোপান-শ্রেণীর সহিত পরিচিত হইয়া উঠিতে কিছু দীর্ঘকাল লাগে। অপূর্ব্ব নূতন লোক, তাই সে প্রতিপদক্ষেপে অত্যন্ত সতর্ক হইয়া দরোয়ানের অনুবর্ত্তী হইয়া উঠিতে লাগিল। দরোয়ান কতকটা উঠিয়া ডান দিকে দোতলার একটা দরজা খুলিয়া দিয়া জানাইল, সাহেব, ইহাই আপনার গৃহ।

 ইহার মুখোমুখি বামদিকের রুদ্ধ দ্বারটা দেখাইয়া অপূর্ব্ব জিজ্ঞাসা করিল, এটাতে কে থাকে?

 দরোয়ান কহিল, কোই এক চীনা সাহেব রহতেঁ হে শুনা।

 অপূর্ব্ব ঠিক তাহার মাথার উপরে তেতালায় কে থাকে প্রশ্ন করায় সে কহিল, এক কালা সাহেব ত রহতেঁ হে দেখা। কোই মান্দ্রাজ-বালে হোয়েঙ্গে জরুর।

 অপূর্ব্ব চুপ করিয়া রহিল। এই একমাত্র আনাগোনার পথে উপরে এবং পার্শ্বে এই দুটি একান্ত ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীর পরিচয়ে তাহার মুখ দিয়া কেবল দীর্ঘশ্বাস পড়িল। নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া তাহার আরও মন খারাপ হইয়া গেল। কাঠের বেড়া দেওয়া পাশাপাশি ছোট বড় তিনটি কুঠরী। একটিতে কল, স্থানের ঘর, রান্নার জায়গা প্রভৃতি অত্যাবশ্যকীয় যাহা কিছু সমস্তই, মাঝেরটি এই অন্ধকার সিঁড়ির ঘর, গৌরবে বৈঠকখানা বলা চলে, এবং সবশেষে রাস্তার ধারের কক্ষটি অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার এবং আলোকিত,—এইটি শয়ন-মন্দির। অফিসের খরচায় এই ঘরটিকেই খাট, টেবিল এবং গুটিকয়েক চেয়ার দিয়া সাজনো হইয়াছে। পথের উপর ছোট একটুখানি বারান্দা আছে, সময় কাটানো অসম্ভব হইলে এখানে দাঁড়াইয়া লোক-চলাচল দেখা যায়। ঘরে হাওয়া নাই, আলো নাই, একটার মধ্যে দিয়া আর একটার যাইতে হয়,—ইহার সমস্তই কাঠের,—দেয়াল কাঠের, মেঝে কাঠের, ছাত কাঠের