পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ভারতী কহিল, আমাদের মুস্কিল হয়েছে, না মুখ দেখে, না কথা শুনে আপনার মনের কথা জানবার জো আছে। ঠিক করে বলে যান কবে ফিরবেন?

 ঐ-যে বললাম, দেশ না জানন্তি—

 না তা হবে না, সত্যি করে বলুন কবে ফিরবেন?

 এত তাগাদা কেন বলত?

 ভারতী কহিল, কি জানি এবার কেমন যেন ভয় করছে। মনে হচ্ছে যেন সব ভেঙে চুরে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাবে। বলিতে বলিতে সহসা তাহার চক্ষু অশ্রুপরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।

 তাহার মাথার উপর হাত রাখিয়া ডাক্তার রহস্যভরে কহিলেন, হবে না গো, হবে না,—সব ঠিক হয়ে যাবে। বলিয়াই হঠাৎ ফিক্ করিয়া হাসিয়া ফেলিয়া কহিলেন, কিন্তু এই মানুষটির সঙ্গে এমন মিছি-মিছি ঝগড়া করলে কিন্তু সত্যিই কাঁদতে হবে তা বলে রাখচি। অপূর্ব্ববাবু রাগ করেন বটে, কিন্তু ভাল যাকে বাসেন তাকে ভালবাসতেও জানেন। মানুষের মধ্যে যে হৃদয়বস্তুটি আছে সে আমাদের সংসর্গে এখনো শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়নি। ফুটন্ত পদ্মটির মত ঠিক তাজা আছে।

 ভারতী কি একটা জবাব দিতে যাইতেছিল, কিন্তু অপূর্ব্ব হঠাৎ মুখ তুলিতেই তাহার মুখের দিকে চাহিয়া তাহার নিজের মুখ বন্ধ হইয়া গেল।

 এমন সময়ে দ্বারের কাছে আসিয়া একখানা ঘোড়ার গাড়ি থামিল এবং অনতিকাল মধ্যেই দুইজন লোক প্রবেশ করিল। একজনের পরিধানে আগাগোড়া সাহেবী পোষাক, ডাক্তার ভিন্ন বোধ করি সকলেরই অপরিচিত; আর একজন রামদাস তলওয়ারকর। অপূর্ব্বর মুখ প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল, কিন্তু কলরব করিয়া সে বন্ধুকে সংবর্দ্ধনা করিতে গেল না। রামদাস অগ্রসর হইয়া ডাক্তারের পদধুলি গ্রহণ করিল। অপূর্ব্বর কাছে ইহা অদ্ভুত ঠেকিল। কিন্তু ডাক্তারের মুখের প্রতি সে শুধু নীরবে নেত্রপাত করিয়া নীরব হইয়াই রহিল।

 ইংরাজি পোষাক পরা লোকটি ইংরাজীতেই কথা কহিলেন, বলিলেন, জামিনের জন্যই এত বিলম্ব ঘটিল। কেস বোধ হয় গভর্ণমেণ্ট চালাবে না।

 ডাক্তার মৃদু হাসিয়া বলিলেন, তার মানে গভর্ণমেণ্টকে তুমি আজও চেননি কৃষ্ণ আইয়ার।

 এই কথায় রামদাস সহাস্যে যোগ দিয়া জিজ্ঞাসা করিল, মাঠ থেকে থানা পর্য্যন্ত আপনাকে সকল সময়েই সঙ্গে দেখেছিলাম, কিন্তু হঠাৎ কখন যে অন্তর্হিত হয়েছিলেন সেইটাই জানতে পারিনি।

 ডাক্তার হাসিমুখে কহিলেন, অন্তর্দ্ধানের গভীর কারণ ঘটেছিল রামদাসবাবু।

১৬০