পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

রইলুম। সে যা হবার হবে, দুর্গা দুর্গা বলে পরশু একবার জাহাজে উঠতে পারলে হয়। এই বলিয়া সে সহসা দীর্ঘশ্বাস মোচন করিল। কিন্তু সেই সঙ্গে যে ইহা অপেক্ষাও শতগুণ গভীর নিশ্বাস আর একজনের হৃদয়ের মূল পর্য্যন্ত নিঃশব্দে তরঙ্গিত হইয়া উঠিল, তাহা সে জানিতেও পারিল না। আর একটা দিনও যেন না অপূর্ব্বর বিলম্ব ঘটে, দুর্গা দুর্গা বলিয়া একবার সে জাহাজে উঠিতে পারিলে হয়! বর্ম্মায় আসা তাহার সর্ব্বাংশেই বিফল হইয়াছে, বাড়ি গিয়া এ দেশের জন-কয়েকের বিষ দৃষ্টির কথাই শুধু তাহার চিরদিন স্মরণে থাকিবে, কিন্তু সকল চক্ষুর অন্তরালে একজনের কুণ্ঠিত দৃষ্টির প্রতি বিন্দু হইতেই যে নীরবে অমৃত ঝরিয়াছে, একটা দিনও হয়ত সে কথা তাহার মনে পড়িবে না।

 অপূর্ব্ব কহিতে লাগিল, এ বাড়িতে পা দিয়েই তোমার বাবার সঙ্গে ঝগড়া হ’ল, কোর্টে জরিমানা পর্য্যন্ত হয়ে গেল, যা জন্মে কখনো আমার হয়নি। এর থেকেই আমার চৈতন্য হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হ’ল না।

 ভারতী চুপ করিয়া ছিল, চুপ করিয়াই রহিল। অপূর্ব্ব নিজেও একমুহূর্ত্ত মৌন থাকিয়া তাহার দুরদৃষ্টের সূত্র ধরিয়া বলিল, তেওয়ারী আমাকে বার বার সাবধান করেছিল,— বাবু, ওরা এক জাত, আমরা এক জাত, এ সব করবেন না। রূপালে দুর্ভোগ থাকলে কে খণ্ডাবে বল? চাকরি সেই গেল,—পাঁচশ’ টাকা মাইনে এ বয়সে কটা লোক পায়? তা’ ছাড়া এ হাত আমি লোকের সুমুখে বার করব কি করে?

 ভারতী আস্তে আস্তে বলিল, ততদিন হাতের দাগ ভাল হয়ে যাবে। ইহার বেশি কথা মুখ দিয়া তাহার বাহির হইল না। মাথায় হাত বুলাইয়া দিতেছিল, সে হাত আর চলিতে চাহিল না এবং এই অত্যন্ত সাধারণ তুচ্ছ লোকটাকে সে মনে মনে ভালবাসিয়াছে মনে করিয়া নিজের কাছেই যেন সে লজ্জায় মরিয়া গেল। এ কথা দলের অনেকেই জানিয়াছে, আজ অপূর্ব্বর প্রাণ বাঁচাইতে গিয়া তাহাদের কাছে অপরাধী এবং সুমিত্রার চক্ষে সে ছোট হইয়া গেছে, কিন্তু এই অতি তুচ্ছ মানুষটাকে হত্যা করিবার অসম্মান ও ক্ষুদ্রতা হইতে সে যে তাহাদের রক্ষা করিতে পারিয়াছে ইহাই মনে করিয়া এখন তাহার গর্ব্ব বোধ হইল।

 অপূর্ব্ব বলিল, দাগ সহজে যাবে না! কেউ জিজ্ঞাসা করিলে যে কি জবাব দেব জানিনে। কিন্তু শ্রোতার নিকট হইতে সায় না পাইয়া আপনিই কহিতে লাগিল, সকলে ভাববে কাজ চালাতে আমি পারলুম না। তাই ত লোকে বলে বাঙালীর ছেলেরা বি. এ., এম. এ. পাশ করে বটে, কিন্তু বড় চাকরি পেলে রাখতে

১৮৪