পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

২২

 জলপথে শত্রু-পক্ষীয় জাহাজের গতিরোধ করিবার উদ্দেশে নদীর ধারে, সহরের শেষ প্রান্তে একটি ছোট রকমের মাটির কেল্লা আছে, এখানে সিপাহী-শান্ত্রী অধিক থাকে না, শুধু ব্যাটারি চালনা করিবার জন্য কিছু গোরা গোলন্দাজ ব্যারাকে বাস করে। ইংরাজের এই নির্ব্বিঘ্ন শান্তির দিনে এখানে বিশেষ কড়া-কড়ি ছিল না; নিষেধ আছে, অন্যমনস্ক পথিক কেহ তাহার সীমানার মধ্যে গিয়া পড়িলে তাড়া করিয়াও আসে, কিন্তু ঐ পর্য্যন্তই। ইহারই একধারে গাছ-পালার মধ্যে পাথরে বাঁধানো একটা ঘাটের মত আছে, হয়ত কোন উচ্চ রাজকর্ম্মচারীর আগমন উপলক্ষ্যে ইহার সৃষ্টি হইয়া থাকিবে, কিন্তু এখন ইহার কাজও নাই, প্রয়োজনও নাই। ভারতী মাঝে মাঝে একাকী আসিয়া এখানে বসিত। কেল্লার রক্ষণাবেক্ষণের ভার যাহাদের প্রতি ছিল তাহাদের কেহ যে দেখে নাই তাহা নহে, সম্ভবতঃ স্ত্রীলোক বলিয়া এবং ভদ্র স্ত্রীলোক বলিয়াই আপত্তি করিত না। বোধ করি এইমাত্র সূর্য্যাস্ত হইয়া থাকিবে, কিন্তু অন্ধকার হইতে তখনও কিছু বিলম্ব ছিল। নদীর কতক অংশে, এবং পরপারবর্ত্তী গাছপালার উপরে শেষ স্বর্ণাভা ছড়াইয়া পড়িয়াছে, দলে দলে পাখীর সারি এদিক হইতে ওদিকে উড়িয়া চলিয়াছে, কাকের কালো দেহে, বকের সাদা পালকে, ঘুঘুর বিচিত্র পাণ্ডুর সর্ব্বাঙ্গে আকাশের রাঙা আলো মিশিয়া হঠাৎ যেন তাহাগিকে কোন অজানা দেশের জীব করিয়া তুলিয়াছে। তাহাদের অবাধ স্বচ্ছন্দ গতি অনুসরণ করিয়া ভারতী নির্নিমেষচক্ষে চাহিয়া রহিল। কি জানি, কোথায় ইহাদের বাসা, কিন্তু সে অলক্ষ্য আকর্ষণ কাহারও এড়াইয়া যাইবার জো নাই। এই কথা মনে করিয়া দুই চক্ষু তাহার জলে ভরিয়া উঠিল। হাত দিয়া মুছিয়া ফেলিয়া চাহিয়া দেখিল দূর বৃক্ষশ্রেণীর সোনার দীপ্তি নিবিয়া আসিতেছে এবং মাথার উপরে গাছপালা নদীতে দীর্ঘতর ছায়াপাত করিয়া জল কালো করিয়া আনিয়াছে এবং তাহারই মধ্য হইতে অন্ধকার যেন সুদীর্ঘ জিহ্বা মেলিয়া সম্মুখের সমস্ত আলোক নিঃশব্দে লেহন করিয়া লইতেছে।

 সহসা নদীর ডানদিকের বাঁক হইতে একখানি ক্ষুদ্র শাম্পান নৌকা সুমুখে উপস্থিত হইল। নৌকার মাঝি ভিন্ন অন্য আরোহী ছিল না। সে চট্টগ্রামী মুসলমান। ক্ষণকাল ভারতীর মুখের দিকে চাহিয়া তাহার চট্টগ্রামের দুর্ব্বোধ্য মুসলমানী বাঙলায় কহিল, আম্মা, ওপারে যাবে? এক খানা পয়সা দিলেই পার করে দিই।

 ভারতী হাত নাড়িয়া কহিল, না, ওপারে আমি যাবো না।

১৯৩