পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ডাক্তার ঘাড় ফিরাইরা নিরুত্তরে দাঁড় টানিয়া চলিতে লাগিলেন, কিছুই বলিলেন না।

 আমার দিকে একবার চাও না দাদা।

 ডাক্তার মুখ ফিরাইয়া চাহিতেই ভারতীর দুই ঠোঁট থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল, কহিল, মানুষ হয়ে মনুষ্য-জন্মের কোথাও কোন বালাই নেই, এমন কি করে হয় দাদা? এই বলিয়া সে দাঁত দিয়া জোর করিয়া তাহার ওষ্ঠাধারের কম্পন নিবারণ করিল, কিন্তু দুই চোখের কোণ বাহিয়া ঝর ঝর করিয়া অশ্রু গড়াইয় পড়িল।

 ডাক্তার সায় দিলেন না, প্রতিবাদ করিলেন না, সান্ত্বনার একটি বাক্যও তাঁহার মুখ দিয়া বাহির হইল না। কেবল পলকের জন্য যেন মনে হইল তাঁহার সুর্ম্মাটানা চোখের দীপ্তি ঈষৎ স্তিমিত হইয়া আসিল।

 ইরাবতীর এই ক্ষুদ্র শাখানদী অগভীর ও অপ্রশস্ত বলিয়া স্টীমার বা বড় নৌকা সচরাচর চলিত না। জেলেদের মাছ ধরার পানসি কিনারায় বাঁধা মাঝে মাঝে দেখা গেল, কিন্তু লোকজন কেহ ছিল না। মাথার উপরে তারা দেখা দিয়াছে, নদীর জল কালো হইয়া উঠিয়াছে, নির্জ্জন ও পরিপূর্ণ নিস্তব্ধতার মধ্যে ডাক্তারের সতর্ক চালিত দাঁড়ের সামান্য একটুখানি শব্দ ভিন্ন আর কোন শব্দ কোথাও ছিল না। উভয় তীরের বৃক্ষশ্রেণী যেন সম্মুখে এক হইয়া মিশিয়াছে। তাহারই ঘনবিন্যস্ত শাখা-পল্লবের অন্ধকার অভ্যন্তরে সজল দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া ভারতী নীরবে স্থির হইয়া বসিয়াছিল। তাহাদের শাম্পান যে কোন ঠিকানায় চলিয়াছিল ভারতী জানিত না, জানিবার মত উৎসুক সচেতন মনের অবস্থাও তাহার ছিল না, কিন্তু সহসা প্রকাণ্ড একটা গাছের অন্তরালে গুল্ম-লতা-পাতা-সমাচ্ছন্ন অতি সঙ্কীর্ণ খাদের মধ্যে তাহাদের ক্ষুদ্র তরী প্রবেশ করিল দেখিয়া সে চকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?

 ডাক্তার কহিলেন, আমার বাসায়।

 সেখানে আর কে থাকে?

 কেউ না।

 কখন আমাকে বাসায় পৌঁছে দেবে?

 পৌঁছে দেব? খাজ রাত্রির মধ্যে যদি না দিতে পারি কাল সকালে যেয়ো।

 ভারতী মাথা নাড়িয়া কহিল, না দাদা, সে হবে না। তুমি আমাকে যেখান থেকে এনেচ সেখানে ফিরে রেখে এস।

 কিন্তু আমার যে অনেক কথা আছে ভারতী

১৯৬