পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

যাইত। নিজের মনে প্রাণপণে বলিতে থাকিত, ইহা কখনও সত্য না, কিছুতে সত্য নয়। এমন হইতেই পারে না।

 কিছুক্ষণ হইতে একটা অপূর্ব্ব সুস্বর মাঝে মাঝে আসিয়া তাহাদের কানে লাগিতে ছিল, সহসা থমকিয়া দাঁড়াইয়া ডাক্তার বলিলেন, ওস্তাদজী আমাদের জেগে আছেন এবং সজ্ঞানে আছেন,—এমন বেহালা তুমি কখনো শোননি ভারতী।

 আরও কয়েক পা অগ্রসর হইয়া ভারতী স্তব্ধ হইয়া থামিল। কোথায় কোন অন্ধকারের বুক চিরিয়া কত কান্নাই যেন ভাসিয়া আসিতেছে। তাহার আদি-অন্ত নাই, এ সংসারে তাহার তুলনা হয় না। মিনিট দুয়ের জন্য ভারতীর যেন সংজ্ঞা রহিল না। ডাক্তার তাহার হাতের উপর একটুখানি চাপ দিয়া কহিলেন, চল।

 ভারতী চকিত হইয়া কহিল, চল। আমি কখনো এমন ভাবিনি, কখনো এমন শুনিনি।

 ডাক্তার আস্তে আস্তে বলিলেন, পৃথিবীতে আমার অগম্য ত স্থান নেই, এর চেয়ে ভাল আমিও কখনো শুনেচি মনে হয় না। একটু হাসিয়া বলিলেন, কিন্তু পাগলার হাতে পড়ে ঐ বেহালা বেচারার দুর্দ্দশার অবধি নেই। আমি বোধ হয়, ওকে দশবার উদ্ধার করে দিয়েছি। এখনো শুনচি অপূর্ব্বর কাছে পাঁচ টাকায় বাঁধা আছে।

 ভারতী কহিল, আছে। ওঁর নাম করে টাকাটা আমি তাঁকে পাঠিয়ে দেব।

 গাছ-পালার আড়ালে একখানা দোতলা কাঠের বাড়ি। একতলাটা পাঁক, জোয়ারের জল এবং দেনো গাছে দখল করিয়াছে, সুমুখে একটা কাঠের সিঁড়ি এবং তারই সর্ব্বোচ্চ ধাপে একটা তোরণের মত করিয়া তাহাতে মস্ত বড় একটা রঙীন চীনা লণ্ঠন ঝুলিতেছে। ভিতরের আলোকে স্পষ্ট পড়া গেল তাহার গায়ে বড় বড় কালো অক্ষরে ইংরাজীতে লেখা, —শশি তারা লজ।

 ভারতী বলিল, বাড়ির নাম রাখা হয়েচে শশি-তারা লজ? লজ তো বুঝলাম, শশি-তারা কি?

 ডাক্তার মুখ টিপিয়া হাসিয়া কহিলেন, বোধ হয় শশিপদর শশী এবং নবতারার তারা এক ক’রে শশি তারা লজ হয়েচে।

 ভারতীর মুখ গম্ভীর হইল, কহিল, এ ভারি অন্যায়। এ সব তুমি প্রশ্রয় দাও কি করে?

 ডাক্তার হাসিয়া ফেলিলেন, কহিলেন, তোমার দাদাটিকে তুমি কি সর্ব্বশক্তিমান মনে কর? কে কার লজের নাম শশি-তারা রাখবে, কে কার প্যালেসের নাম অপূর্ব্ব-ভারতী রাখবে, সে আমি ঠেকাব কি করে?

২১৩