পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তাই ভাঁটা ঠেলিয়া কষ্ট করিয়াই চলিতে হইল। খাঁড়ির মুখে একখানা জাপানী জাহাজ কিছুদিন হইতে বাঁধা ছিল, সেই স্থানটা নিঃশব্দে পার হইয়া ভারতী কথা কহিল। বলিল, এই কয়দিন থেকে থেকে কেবলি মনে হ’তো, দাদা, সমুদ্রের যেমন তল নেই, তোমার তেমনি তল নেই। স্নেহ বল, ভালবাসা বল; কিছুই তোমাতে ভর দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারে না। সবই যেন কোথায় তলিয়ে চলে যায়।

 ডাক্তার বলিলেন, প্রথমতঃ সমুদ্রের তল আছে, সুতরাং উপমা তোমার এ ক্ষেত্রে অচল।

 ভারতী কহিল, এই নিয়ে বোধ হয় তোমাকে একশ’ বার বললাম যে, তুমি ছাড়া দুনিয়ায় আমার আর আপনার কেউ নেই,—তুমি চলে গেলে আমি দাঁড়াবো কোথায়? কিন্তু এ কথা তোমার কানেই পৌঁছল না। আর পৌঁছবে কি করে দাদা, হৃদয় ত নেই। আমি ঠিক জানি একবার চোখের আড়াল হলে তুমি নিশ্চয় আমাকে ভুলে যাবে।

 ডাক্তার বলিলেন, না। তোমাকে নিশ্চয় মনে থাকবে।

 ভারতী প্রশ্ন করিল, কি আশ্রয় করে আমি সংসারে থাকবো?

 ডাক্তার বলিলেন, ভাগ্যবতী মেয়েরা যা আশ্রয় করে থাকে। স্বামী, ছেলেপুলে, বিষয়-আশয়, ঘরদোর—

 ভারতী রাগ করিয়া বলিন, আমি যে অপূর্ব্ববাবুকে একান্তভাবেই ভালবেসেছিলাম এ সত্য তোমার কাছে গোপন করিনি; তাঁকে পেলে একদিন যে আমার সমস্ত জীবন ধন্য হয়ে যেতো এ কথাও তুমি জানো,—তোমার কাছে কিছু লুকানোও যায় না,—কিন্তু তাই বলে আমাকে তুমি অপান করবে কিসের জন্যে?

 ডাক্তার আশ্চর্য্য হইয়া বলিলেন, অপমান! অপমান ত তোমাকে আমি এতটুকু করিনি ভারতী?

 সহসা অশ্রু-আভাসে ভারতীর কণ্ঠ ভারী হইয়া উঠিল, কহিল, না, করনি বই কি! তুমি জানো কত শত-সহস্র বাধা, তুমি জানো তিনি আমাকে গ্রহণ করতেই পারেন না,—তবুও তুমি এইসব বলবে?

 ডাক্তার ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, এই ত মেয়েদের দোষ। তারা নিজেরা একদিন যা বলে, অপরে তাই আর একদিন উচ্চারণ করলেই তারা তেড়ে মারতে আসে! সেদিন সুমিত্রার কথায় বললে সে কাকে যেন একদিন পায়ের তলার টেনে এনে ফেলবে, আজ আমি তারই পুনরাবৃত্তি করার কান্নায় গলা তোমার বুঁজে এলো!

 ভারতী চোখ বুজিয়া বলিল, না, তুমি কখ্‌খনো এসব কথা আমাকে বলতে পাবে না।

২৩৩