পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

স্বাধীনতাই স্বাধীনতার শেষ নয়। ধর্ম্ম, শান্তি, কাব্য, আনন্দ—এরা আরও বড়। এদের একান্ত বিকাশের জন্যই ত স্বাধীনতা, নইলে এর মূল্য ছিল কোথা? এর জন্যে তোমাকে আমি হত্যা করতে পারব না বোন, তোমার মধ্যে যে হৃদয় স্নেহে, প্রেমে, করুণায়, মাধুর্য্যে এমন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেচে, সে আমার প্রয়োজনকে অতিক্রম করে বহু উর্দ্ধে চলে গেছে,—তার নাগাল আমি হাত বাড়িয়ে পাব না।

 ভারতীর সর্ব্বাঙ্গ পুলকে কণ্টকিত হইয়া উঠিল। সব্যসাচীর গভীর অন্তরের একটা অপরূপ মূর্ত্তি সে যেন সহসা চক্ষে দেখিতে পাইল। ভক্তি ও আনন্দে বিগলিত হইয়া কহিল, আমিও তাই ভাবি দাদা, তোমার অজানা সংসারে কি আছে! আর তাই যদি হোলো, কি হেতু তুমি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে আছ? দেশে বিদেশে গুপ্ত সমিতি সৃষ্টি করে বেড়ানো তোমার কিসের জন্যে। মানবের চরম কল্যাণ ত কোনদিনই এর মধ্যে থেকে হতে পারবে না।

 ডাক্তার বলিলেন, ঠিক তাই। কিন্তু চরম কল্যাণের ভার আমরা বিধাতার হাতে ছেড়ে দিয়ে ক্ষুদ্র মানবের সাধ্যের মধ্যে যে সামান্য কল্যাণ তারই চেষ্টাতে নিযুক্ত আছি। নিজের দেশের মধ্যে স্বাধীনভাবে কথা কওয়া, স্বাধীনভাবে চলেফিরে বেড়ানোর অতি তুচ্ছ অধিকার—এর অধিক সম্প্রতি আর আমরা কিছুই চাইনে ভারতী।

 ভারতী কহিল, সে ত সবাই চায়, দাদা। কিন্তু তার জন্যে নরহত্যার ষড়যন্ত্র কিসের জন্যে বল ত? কি তার প্রয়োজন? কিন্তু কথাটা উচ্চারণ করিয়া ফেলিয়া সে অত্যন্ত লজ্জিত হইল। কারণ, এ অভিযোগ শুধু রূঢ় নয়, অসত্য।

 তৎক্ষণাৎ অনুতপ্ত চিত্তে কহিল, আমাকে মাপ কর দাদা, এ মিধ্যে আমি শুধু রাগের উপরেই বলে ফেলেছি। আমাকে তুমি ফেলে যাবে—এ যেন আমি ভাবতেই পারচিনে।

 ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন, তা আমি জানি।

 ইহার পরে বহুক্ষণ পর্য্যন্ত আর কোন কথাবার্ত্তা হইল না। এই সময়ে কিছুদিন হইতে ‘স্বদেশী আন্দোলন’ ভারতবর্ষব্যাপী হইয়া উঠিয়াছিল। ভক্তিভাজন নেতৃবৃন্দ দেশোদ্ধারকল্পে আইন বাঁচাইয়া যে সকল জ্বালাময়ী বক্তৃতা অবকাশ মত দিয়া বেড়াইতেছিলেন তাহারই সারাংশ সংবাদপত্র-স্তম্ভে মাঝে মাঝে পাঠ করিয়া ভারতী সশ্রদ্ধবিস্ময়ে আপ্লুত হইয়া উঠিত। বিগত রাত্রে এমনি ধারা কি একটা রোমাঞ্চকর রচনা খবরের কাগজে পাঠ করিয়া অবধি তাহার মধ্যে উত্তেজনার তপ্ত বাতাস সারাদিন ধরিয়া আজ বহিয়া ফিরিতেছিল। তাহাই স্মরণ করিয়া কহিল, আমি জানি ইংরাজ রাজত্বে তোমার স্থান নেই। কিন্তু সমস্ত দুনিয়াই ত তাদের নয়।

২৩৫