পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তোমার বোন। বাঙলার মাটি, বাঙলার মানুষকে আমি প্রাণাধিক ভালবাসি। কে জানে, যে-জীবন তুমি বেছে নিয়েচ, হয়ত আজই আমাদের শেষ দেখা। আজ আমাকে তুমি শান্ত মনে এই জবাবটি দিয়ে যাও, যেন এরই দিকে চোখ রেখে আমি সারাজীবন মুখ তুলে সোজা চলে যেতে পারি। বলিতে বলিতে শেষের দিকে তাহার কণ্ঠস্বর কান্নার ভারে একেবারে ভাঙিয়া পড়িল।

 ডাক্তার নীরবে তরী বাহিতে লাগিলেন। বিলম্ব দেখিয়া ভারতীর মনে হইল, বোধ হয় তিনি ইহার উত্তর দিতে চান না। সে হাত বাড়াইয়া নদীর জলে চোখ মুখ ধুইয়া ফেলিল, অঞ্চল দিয়া বার বার ভাল করিয়া মুছিয়া পুনরায় কি একটা প্রশ্ন করিতেছিল, ডাক্তার কথা কহিলেন। স্নিগ্ধ মৃদু কণ্ঠ, কোথাও লেশমাত্র উত্তেজনা বা বিদ্বেষের আভাস নেই, যেন কাহার কথা কে বলিতেছে এখনি শান্ত সহজ। ভারতীর সেই প্রথম পরিচয় দিনের স্কুলের নিরীহ নির্ব্বোধ মাস্টার মহাশয়টিকে মনে পড়িল। অশুদ্ধ ইংরাজি উচ্চারণ, ব্যাকরণও তেমনি,—ভারতী কষ্টে হাসি চাপিয়া আলাপ করিয়াছিল। পরে তাই লইয়া রাগ করিয়া সে ডাক্তারকে অনেকদিন অনেক তিরস্কার করিয়াছে! সেই নিরুৎসুক নিঃস্পৃহকণ্ঠে কহিলেন, এক রকমের সাপ আছে ভারতী, তারা সাপ খেয়েই জীবন ধারণ করে। দেখেচ?

 ভারতী বলিল, না, দেখিনি, শুনেচি।

 ডাক্তার বলিলেন, পশুশালায় আছে। এবার কলকাতায় গিয়ে অপূর্ব্বকে হুকুম কোরো সে দেখিয়ে আনবে।

 বার বার ঠাট্টা করো না দাদা, ভাল হবে না বলচি।

 না, ভাল হবে না, আমিও ভাই বলচি। পাশাপাশি বাস করাটা ঠিক ঘটে ওঠে না বটে, কিন্তু আরও ঘনিষ্ঠভাবে একজনের জঠরের মধ্যে আর একজন বেশ নিরাপদেই স্থান পায়। বিশ্বাস না হয় জু’র অধ্যক্ষকে জিজ্ঞাসা ক’রে দেখো।

 ভারতী চুপ করিয়া রইল।

 ডাক্তার বলিলেন, তুমি তাদের সমধর্ম্মাবলম্বী, তাদের কাছে অশেষ ঋণে ঋণী, তাদের অনেক সদগুণ চোখে দেখেচ—দেখেচ তাদের বিশ্বগ্রাসী বিরাট ক্ষুধার পরিমাণ? এদেশের মালিক তারা,—মালিকানার তারিখ মনে আছে ত? আজ বৃটিশসম্পদের তুলনা হয় না। কত জাহাজ, কত কলখারখানা, কত শত সহস্র ইমারত। মানুষ মারবার উপকরণ আয়োজনের আর অন্ত নেই। তার সমস্ত অভাব, সর্ব্বপ্রকার প্রয়োজন মিটিয়েও ইংরেজ ১৮১০ সাল থেকে সত্তরবছরের মধ্যে কেবল বাইরে দিয়েছিল ঋণ তিন হাজার কোটী টাকা। জানো এই বিরাট ঐশ্বর্য্যের উৎস কোথায়? আপনাকে তুমি বাঙালাদেশের মেয়ে বলছিলে না? বাঙলার মাটি, বাঙলার জল-বায়ু,

২৪০