পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বলিয়া তাঁহাকে চমকিত করিয়া দিল। ভারতীর এই রূপ অপরিচিত, মনোভাব অপ্রত্যাশিত। তথাপি যে ধর্ম্ম-বিশ্বাস ও সভ্যতার ঘনিষ্ঠ প্রভাবের মধ্যে সে বালিকা বয়স হইতে মানুষ হইয়া উঠিয়াছে, তাহারই আঘাতে চঞ্চল ও অসহিষ্ণু হইয়া সে এই যে নির্ভীক প্রতিবাদ করিয়া বসিল, তাহা যত কঠিন ও প্রতিকূল হৌক, সব্যসাচীর চক্ষে তাহাকে যেন নব মর্য্যাদা দান করিল।

 তাঁহাকে নিরুত্তর দেখিয়া ভারতী বলিল, কই জবাব দিলে না দাদা? এত বড় হিংসের আগুন বুকের মধ্যে জ্বালিয়ে তুমি আর যাই কর দেশের ভালো করতে পারবে না।

 ডাক্তার কহিলেন, তোমাকে ত অনেকবার বলেচি দেশের ভালো যারা করবেন তাঁরা চাঁদা তুলে দিকে দিকে অনাথ-আশ্রম, ব্রহ্মচর্য্যাশ্রম, বেদান্ত-আশ্রম, দরিদ্রভাণ্ডার প্রভৃতি নানা হিতকর কার্য্য করচেন, মহৎ লোক তাঁরা, আমি তাঁদের ভক্তি করি,—এই দেশের ভালো করার ভার আমি নিইনি, আমি স্বাধীন করার ভার নিয়েছি। একটুখানি থামিয়া বলিলেন, আমার বুকের আগুন নেভে শুধু দুটো জিনিস দিয়ে। এক নিজের চিতাভস্মে, আর নেভে যে দিন শুনবো ইয়োরোপের ধর্ম্ম, সভ্যতা, নীতি সমুদ্রের অতল গর্ভে ডুবেচে।

 ভারতী স্তব্ধ হইয়া রহিল। তিনি বলিতে লাগিলেন, এই বিষকুম্ভের পরিপূর্ণ সওদা নিয়ে সমুদ্র পার হয়ে ইয়োরোপ যখন প্রথম ব্যাসাত করতে এসেছিল, তখন চিনতে পেরেছিল কেবল জাপান। তাই আজ তার সৌভাগ্য, তাই আজ সে ইয়োরোপের সমকক্ষ সম্ভ্রান্ত মিতা! কিন্তু চিনতে পারেনি ভারত, চিনতে পারেনি চীন, তখন স্পেনের রাজা পৃথিবীময়, ক্ষুদ্র জাপান স্পেনের এক নাবিককে বিজ্ঞাসা করে, এত রাজ্য হল তোমাদের কি করে? (নাবিক বললে, অতি সহজে, যে দেশ আত্মসাৎ করতে চাই, সেখানে নিয়ে যাই প্রথমেই মাল, হাতে পারে পড়ে ব্যবসার জন্যে দেশের রাজার কাছে চেয়ে নিই এক ফোঁটা জমি। তার পরে আনি মিশনারী, তারা যত না করে ক্রীশ্চান, তার বেশি করে সে দেশের ধর্ম্মকে গালিগালাজ। লোকে ক্ষেপে উঠে হঠাৎ ফেলে দু-একটাকে মেরে। তখন আসে আমাদের কামান-বন্দুক, আসে আমাদের সৈন্য-সামন্ত। আমাদের সভ্য দেশের মানুষ-মারা কল যে যে অসভ্য দেশের চেয়ে কত শ্রেষ্ঠ তা অচিরেই প্রমাণিত করে দিই। শুনে জাপান বললে, প্রভু! আপনারা তাহলে গা তুলুন, আমাদের আর ব্যবসাতে কাজ নেই। এই বলে তাদের বিদায় দিয়ে নিজেদের দেশের মধ্যে আইন জারি করে দিলে,চন্দ্র সূর্য্য যতদিন উদয় হবে ক্রীশ্চান যেন না আর আমাদের দেশে পা দেয়। দিলে তার প্রাণদণ্ড।

২৪৩