পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

লাগিল। অপূর্ব্বর মাকে সে দেখেও নাই এবং স্বামী পুত্র লইয়া এ জীবনে তিনি অনেক দুঃখ পাইয়াছেন—এ ছাড়া তাঁহার সম্বন্ধে সে বিশেষ কিছু জানিতও না, কিন্তু কতদিন নিজের নিরালা ঘরের মধ্যে সে রাত্রি জাগিয়া এই বর্ষীয়সী বিধবা রমণীর সম্বন্ধে কত কল্পনাই না করিয়াছে! সুখের মাঝে নয় দুঃখের দিনে কখনো যদি দেখা হয় যখন সে ছাড়া আর কেহ তাঁহার কাছে নাই, তখন ক্রীশ্চান বলিয়া কেমন করিয়া তাহাকে তিনি দূরে সরাইয়া দিতে পারেন—এ কথা জানিবার তাহার ভারি সাধ ছিল। বড় সাধ ছিল দুর্দ্দিনের সেই অগ্নি পরীক্ষায় আপন-পর সমস্যার সে শেষ সমাধান করিয়া লইবে। ধর্ম্মমতভেদই এ-জগতে মানুষের চরম বিচ্ছেদ কি না, এই সত্য যাচাই করিবার সেই পরম দুঃসময়ই ভাগ্যে তাহার আসিয়াছিল, কিন্তু সে গ্রহণ করিতে পারে নাই। এ রহস্য এ জীবনে অমীমাংসিতই রহিয়া গেল।

 আর অপূর্ব্ব! সে যে আজ কত বড় নিঃসহায়, কতখানি একা, ভারতীর অপেক্ষা তাহা কে বেশি জানে? হয়ত, মাতার একান্ত মনের আশীর্ব্বাদই তাহাকে কবচের মত অদ্যাবধি রক্ষা করিয়া আসিতেছিল, আজ তাহা অন্তর্হিত হইল। ভারতী মনে মনে বলিল, এ সকল তাহার আকাশ-কুসুম, তাহার নিগূঢ় হৃদয়ের স্বপ্ন রচনা বই আর কিছু নয়, তবু যে সেই স্বপ্ন তাহার নির্দ্দেশহীন ভবিষ্যতের কতখানি স্নিগ্ধ-শ্যাম শোভায় অপরূপ করিয়া রাখিত সে ছাড়া এ কথাই বা আর কে জানে? কে জানে তাহার চেয়ে বেশি ঘরে-বাহিরে অপূর্ব্ব আজ কিরূপ নিরুপায়, কইখানে সঙ্গিহীন!

 এ প্রবাসভূমে হয়ত অপূর্ব্বর কর্ম্ম নাই, হয়ত, আত্মীয়-স্বজন তাহাকে ত্যাগ করিয়াছে, ভীরু, লোভী, নীচাশয় বলিয়া বন্ধুজন মধ্যে সে নিন্দিত,—আর সকল দুঃখের বড় দুঃখ মা আজ তাহার লোকান্তরিত। ভারতীর মনে হইল, পরিচিত কাহারও কাছে অপূর্ব্ব লজ্জায় যাইতে পারে নাই বলিয়াই বোধ হয় সকল লজ্জা বিসর্জ্জন দিয়া সে বারবার তাহারই কাছে ছুটিয়া আসিয়াছিল। উদ্যমের পটুতা, ব্যবস্থার শৃঙ্খলা, কার্য্যের তৎপরতা কিছুই তাহার নাই, অথচ, অতিথিশালার অসহ্য জনতা ও কোলাহল এবং সর্ব্ববিধ অভাব ও অসুবিধার মধ্যে সেই মায়ের মৃত্যু যখন আসন্ন হইয়া আসিয়াছে, তখন একাকী কি করিয়া যে তাহার মুহূর্ত্তগুলি কাটিয়াছে, এই কথা কল্পনা করিয়া চোখের জল তাহার যেন থামিতে চাহিল না। চোখ মুছিতে মুছিতে যে কথা তাহার বহুবার মনে হইয়াছে, সেই কথাই স্মরণ হইল, যেন সকল দুঃখের সূত্রপাত অপূর্ব্বর তাহার সহিত পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গেই জন্ম লইয়াছে। না হইলে পিতা ও অগ্রজের উচ্ছৃঙ্খলতার প্রতিকূলে যখন সে মাতার পক্ষ অবলম্বন করিয়া শতেক দুঃখ সহিয়াছে, তখন স্বার্থবুদ্ধি তাহাকে সত্য পথভ্রষ্ট করে নাই

২৭৩