পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

অপরিচিত তাহাকে গৃহে প্রবেশ করিতে দেখিয়া কেহ নিষেধ করিল না। মিনিট পাঁচ-ছয় স্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া ভারতী ধীরে ধীরে ডাকিল, অপূর্ব্ববাবু!

 অপূর্ব্ব উঠিয়া বসিয়া তাহার মুখের প্রতি একবার চাহিল, তারপরে দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজিয়া ক্ষণকাল নিঃশব্দে স্থিরভাবে থাকিয়া চোখ তুলিয়া সোজা হইয়া বসিল। সদ্য মাতৃ বিয়োগের সীমাহীন বেদনা তাহার মুখের উপরে জমাট হইয়া বসিয়াছে, কিন্তু আবেগের চাঞ্চল্য নেই—শোকাচ্ছন্ন গভীর দৃষ্টির সন্মুখে এ পৃথিবীর সমস্ত কিছুই যেন তাহার একেবারে মিথ্যা হইয়া গেছে। মাতার পক্ষপুটচ্ছায়া-বাসী যে অপূর্ব্বকে একদিন সে চিনিয়াছিল, এ সে মানুষ নয়। আজ তাহাকে মুখোমুখি দেখিয়া ভারতী বিস্ময়ে এমনি অবাক হইয়া রহিল যে, কোন কথা বলিবে, কি বলিয়া ডাকিবে কিছুই ভাবিয়া পাইল না। কিন্তু ইহার মীমাংসা করিয়া দিল অপূর্ব্ব নিজে। সে-ই কথা কহিল, বলিল, এখানে বসবার কিছু নেই ভারতী, সমস্তই ভিজে, তুমি বরঞ্চ ঐ তোরঙ্গটার উপরে বোস।

 ভারতী উত্তর দিল না, কপাটের চৌকাঠ ধরিয়া নতনেত্রে যেমন দাঁড়াইয়া ছিল তেমনি স্থির হইয়া রহিল। তাহার পরে বহুক্ষণ অবধি দু’জনের কেহই কোন কথা কহিতে পারিল না।

 হিন্দুস্থানী চাকরটা তেল কিনিতে দোকানে গিয়াছিল, সে ঘরে ঢুকিয়া প্রথমে বিস্মিত হইল, পরে হারিকেন লণ্ঠনটা তুলিয়া বাহির হইয়া গেল।

 অপূর্ব্ব কহিল, ভারতী বোস।

 ভারতী বলিল, বেলা নেই, বসলে সন্ধ্যে হয়ে যাবে যে!

 এখ্‌খুনি যাবে? একটুও বসতে পারবে না?

 ভারতী ধীরে ধীরে গিয়া সেই তোরঙ্গটার উপরে বসিয়া এক মুহূর্ত্ত মৌন থাকিয়া বলিল, মা যে এখানে এসেছিলেন আমি জানতাম না। তাঁকে দেখিনি, কিন্তু বুকের ভেতরটা আমার পুড়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে তুমি আমাকে আর দুঃখ দিয়ো না। বলিতে বলিতে চোখ দিয়া তাহার জল গড়াইয়া পড়িল।

 অপূর্ব্ব স্তব্ধ হইয়া রহিল। ভারতী অঞ্চলে অশ্রু মুছিয়া কহিল, সময় হয়েছিল, মা স্বর্গে গেছেন। প্রথমে মনে হয়েছিল, এজন্মে তোমাকে আর আমি মুখ দেখাতে পারবো না, কিন্তু এমন করে তোমাকে ফেলে রেখেই বা আমি থাকবো কি করে? সঙ্গে গাড়ি আছে, ওঠো, আমার বাসায় চল। আবার তাহার চক্ষু অশ্রুপ্লাবিত উঠিল।

 ভারতীর ভয় ছিল অপূর্ব্ব হয়ত শেষ পর্য্যন্ত ভাঙ্গিয়া পড়িবে, কিন্তু তাহার শুষ্ক চক্ষে জলের আভাস পর্য্যন্ত দেখা দিল না, শান্তস্বরে কহিল, অশৌচের অনেক

২৭৬