পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ইত্যবসরে এই ব্যাপার। তার বিশ্বাস এ-কাজ ও-ছাড়া আর কেউ করেনি। আমারও অনুমান কতকটা তাই। চুরি না করুক সাহায্য করেচে।

 তারপর?

 তারপয় সকালে গেলাম পুলিশে খবর দিতে। কিন্তু পুলিশের দল এমন কাণ্ড করলে, এমন তামাসা দেখালে যে ও কথা আর মনেই হল না। এখন ভাবচি, যা গেছে তা যাক, তাদের চোর ধরে দিয়ে আর কাজ নেই, তারা বরঞ্চ এমনিধারা বিদ্রোহী ধরে ধরেই বেড়াক। এই বলিয়া তাহার গিরীশ মহাপাত্র ও তাহার পোষাকপরিচ্ছদের বাহার মনে পড়িয়া হঠাৎ হাসির ছটায় যেন দম আটকাইবার উপক্রম হইল। হাসি থামিলে সে বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রে অসাধরণ পারদর্শী বিলাতের ডাক্তার উপাধিধারী রাজশত্রু মহাপাত্রের স্বাস্থ্য, তাহার শিক্ষা ও রুচি, তাহার বলবীর্য্য, তাহার রামধনু-রঙের জামা, সবুজ রঙের মোজা ও লোহার নাল-ঠোকা পাম্প-শু, তাহার লেবুর তেলের গন্ধবিলাস, সর্ব্বোপরি তাহার পরহিতায় গাঁজার কলিকাটির আবিষ্কারের ইতিহাস সবিস্তারে বর্ণনা করিতে করিতে তাহার উৎকট হাসির বেগ কোন মতে আর একবার সংবরণ করিয়া শেষে কহিল, তলওয়ারকর, মহা হুঁশিয়ারি পুলিশের দলকে আজকের মত নির্ব্বোধ আহম্মক হতে বোধকরি কেউ কখনো দেখেনি। অথচ, গভর্ণমেণ্টের কত টাকাই না এরা বুনো হাঁসের পিছনে ছুটোছুটি করে অপব্যয় করলে।

 রামদাস হাসিয়া কহিল, কিন্তু বুনো হাঁস ধরাই যে এদের কাজ, আপনার চোর ধরে দেবার জন্যে এরা নেই। আচ্ছা, এরা কি আপনাদের বাঙলা দেশের পুলিশ?

 অপূর্ব্ব কহিল, হ্যাঁ। তা’ ছাড়া আমার বড় লজ্জা এই যে, এঁদের যিনি কর্ত্তা তিনি আমার আত্মীয়, আমার পিতার বন্ধু। বাবাই একদিন এর চাকরি করে দিয়েছিলেন।

 রামদাস কহিল, তাহলে আপনাকেই হয়ত আর একদিন তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। কিন্তু কথাটা বলিয়া ফেলিয়া সে-ই একটু অপ্রতিভ হইয়া চুপ করিল— আত্মীয়ের সম্বন্ধে এরূপ একটা মন্তব্য প্রকাশ করা হয়ত শোভন হয় নাই।

 অপূর্ব্ব তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া অর্থ বুঝিল, কিন্তু এ ধারণা যে সত্য নয়, ইহাই সতেজে ব্যক্ত করিতে সে জোর করিয়া বলিল, আমি তাঁকে কাকা বলি, আমাদের তিনি আত্মীয়, শুভাকাঙ্খী, কিন্তু তাই বলে আমার দেশের চেয়ে ত তিনি আপনার নন। বরঞ্চ, যাঁকে তিনি দেশের টাকায়, দেশের লোক দিয়ে শিকারের মত তাড়া করে বেড়াচ্চেন, তিনি ঢের বেশি আমার আপনার।

 রামদাস মুচকিয়া একটু হাসিয়া কহিল, বাবুজী, এ-সব কথা বলায় দুঃখ আছে।

 অপূর্ব্ব কহিল, থাকে, তাই নেব। কিন্তু তাই বলে তলওয়ারকর,—শুধু কেবল

৫৩