পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 সে খানিক পরে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল অপূর্ব্ব কোনমতে ফল কাটা শেষ করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে। কহিল, বসে আছেন, খাননি?

 অপূর্ব্ব বলিল, না, আপনার জন্যে বসে আছি।

 কিসের জন্য?

 আপনি খাবেন না?

 না। দরকার হলে আমার আলাদা আছে।

 অপূর্ব্ব ফলের থালাটা হাত দিয়া একটুখানি ঠেলিয়া দিয়া বলিল, বাঃ—তা’ কি কখন হয়? আপনি সারাদিন খাননি, আর।

 তাহার কথাটা তখনো শেষ হয় নাই, একটা অত্যন্ত শুষ্ক চাপা কণ্ঠস্বরে জবাব আসিল, আঃ—আপনি ভারি জ্বালাতন করেন। ক্ষিদে থাকে খান, না হয় জানালা দিয়ে ফেলে দিন। এই বলিয়া সে মুহূর্ত্ত অপেক্ষা না করিয়া ও-ঘরে চলিয়া গেল। বস্তুতঃ মূহূর্ত্ত মাত্রই তাহার মুখের চেহারা অপূর্ব্ব দেখিতে পাইয়াছিল, কিন্তু সে মুহূর্ত্তকালই তাহার বুকে মরণকাল পর্য্যন্ত ছাপ মারিয়া দিল। এ মুখ সে আর তুলিল না। সেই আসার দিন হইতে অনেকবার দেখা হইয়াছে; বিবাহে, সৌহৃদ্যে, শত্রুতায়, বন্ধুত্বে, সম্পদে ও বিপদে কতবার ত এই মেয়েটিকে সে দেখিয়াছে, কিন্তু সে-দেখার সহিত এ-দেখার সাদৃশ্য নাই। এ যেন আর কেহ।

 ভারতী চলিয়া গেল, ফলের পাত্র তেমনি পড়িয়া রহিল এবং তেমনি নির্ব্বাক নিষ্পদ কাঠের মত অপূর্ব্ব বসিয়া রহিল। কিসে যে কি হইল সে যেন তাহার উপলব্ধির অতীত।

 ঘণ্টাখানেক পরে সে এ-ঘরে আসিয়া দেখিল তেওয়ারীর শিয়রের কাছে একটা মাদুর পাতিরা ভারতী বাহুতে মাথা রাখিয়া ঘুমাইতেছে। সে যেমন নিঃশব্দে আসিয়াছিল তেমনি নিঃশব্দে ফিরিয়া গিয়া তাহার খাটে শুইয়া পড়িল এবং শ্রান্ত চক্ষু মুদ্রিত হইতে তিলার্দ্ধ বিলম্ব হইল না। এই ঘুম যখন ভাঙিল তখন ভোর হইয়াছে।

 ভারতী কহিল, আমি চললুম।

 অপূর্ব্ব ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল, কিন্তু ভাল করিয়া চেতনা হইবার পূর্ব্বেই দেখিল, সে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেছে।

৭৮