পাতা:পথের পাঁচালী.djvu/১৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
পথের পাঁচালী
১৫১

 সেটা যে শ্রেণীর মুদ্রাই হউক সেইটাই অন্য সুরে দিতে আসিলে হরিহর লাইতে কিছুমাত্র আপত্তি করিত না-এরূপ সে বহুস্থানে লইয়াছেও; কিন্তু সে বিনীতভাবে বলিল-আজ্ঞের আপনি রাখুন, আমি এমনি কারুর কাছে নিইনে—আমি শাস্ত্ৰ পাঠ-টাটু করি।–তা ছাড়া কাবুর কাছে-আচ্ছা থাক–

একটু শুভযোগ বোধ হয় ঘটিয়াছিল। রক্ষিত মহাশয়ের কাঠের গোলাতেই একদিন একটা সন্ধান জুটিল। কৃষ্ণনগরের কাছে একটা গ্রামে একজন বর্ধিষ্ণু মহাজন গৃহ-দেবতার পূজা-পাঠ করিবার জন্য একজন ব্রাহ্মণ খুঁজতেছে, যে বরাবর টিকিয়া থাকিবে। রক্ষিত মহাশয়ের যোগাযোগে অবিলম্বে হরিহর সেখানে গেল-বাড়ির কর্তাও তাহাকে পছন্দ করিলেন। থাকিবার ঘর দিলেন, আদর-আপ্যায়নের কোন ত্রুটি হইল না।

কয়েকদিন কাজ করিবার পরেই পূজা আসিয়া পড়িল। বাড়ি যাইবার সময় বাড়ির কর্তী দশ টাকা প্ৰণামী ও যাতায়াতের গাড়িভাড়া দিলেন, গোয়াড়ীতে রক্ষিত মহাশয়ের নিকট বিদায় লইতে আসিলে সেখান হইতেও পাঁচটি টাকা প্ৰণামী পাওয়া গেল।

আকাশে-বাতাসে গরম রৌদ্রের গন্ধ, নীল নির্মেঘ আকাশের দিকে চাহিলে মনে হঠাৎ উল্লাস আসে, বর্ষাশেষের সরস সবুজ লতাপাতায় পথিকের চরণভঙ্গিতে কেমন একটা আনন্দ মাখানো। রেলপথের দুপাশে কাশ ফুলের ঝাড় গাড়ির বেগে লুটাইয়া পড়িতেছে, চলিতে চলিতে কেবলই বাড়ির কথা মনে হয়।

একদল শাস্তিপুরের ব্যবসায়ী লোক পূজার পূর্বে কাপড়ের গোট ক্ৰয় করিতে কলিকাতায় গিয়াছিল, চুণীঘাটের খেয়ার নৌকায় উঠিয়া কলরব করিতেছে-সর্বত্র একটা উৎসবের উল্লাস। রানাঘাটের বাজারে সে স্ত্রী ও পুত্রকন্যার জন্য কাপড় কিনিল। দুৰ্গা লালপাড় কাপড় পরিতে ভালোবাসে, তাহার জন্য বাছিয়া একখানা ভালো কাপড়, ভালো দেখিয়া আলতা কয়েক পাতা। অপুর ‘পদ্মপুরাণ’ অনেক সন্ধান করিয়াও মিলিল না, অবশেষে একখানা ‘সচিত্র চণ্ডী-মাহাত্ম্য বা কালকেতুর উপাখ্যান’ ছয় আনা মূল্যে কিনিয়া লইল। গৃহস্থলির টুকটাক দু’একটা জিনিস সর্বজয়া বলিয়া দিয়াছিল–একটা কাঠের চাকি-বেলুনের কথা, তাহাও কিনিল।

দেশের স্টেশনে নামিয়া হ্যাঁটিতে হ্যাঁটিতে বৈকালের দিকে সে গ্রামে আসিয়া পৌঁছিল। পথে বড় একটা কাহারও সহিত দেখা হইল না, দেখা হইলেও সে হন হন করিয়া উদ্বিগ্নচিত্তে কাহারও দিকে বিশেষ লক্ষ না করিয়া বাড়ির দিকে চলিল। দরজায় ঢুকিতে ঢুকিতে আপন মনে বলিল-উঃ, দ্যাখো কাণ্ডখানা, বাঁশ-ঝাড়টা বুকে পড়েচে একেবারে পাচিলের ওপর, ভুবন কাকা কাটাবেনও নামুশকিল হয়েচে আচ্ছা-পরে সে বাড়ির উঠানে ঢুকিয়া অভ্যাসমতো আগ্রহের সুরে ডাকিল-ওমা দুগগা-ও অপু–

তাহার গলার স্বরা শুনিয়া সর্বজয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল।

হরিহর হাসিয়া বলিল-বাড়ির সব ভালো? এরা সব কোথায় গেল? বাড়ি নেই বুঝি?

সর্বজয়া শান্তভাবে আসিয়া স্বামীর হাত হইতে ভারী পুঁটুলিটা নামাইয়া লইয়া বলিল, এসো—ঘরে