পাতা:পথের পাঁচালী.djvu/৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
পথের পাঁচালী
পথের পাঁচালী

সর্বজয়া একবাটি দুধ-ভাত মাখিয়া পুত্রকে খাওয়াইতে বসিল। দেখি হাঁ কর–তোমার কপালখানা–মণ্ডা না মেঠাই না, দুটো ভাত আর ভাত–তা ছেলের দশা দেখলে হয়ে আসে–রোজ ভাত খেতে বসে মুখ কাচুমাচু-বাঁচবে কি খেয়ে? বাঁচতে কি এসেচ? আমায় জ্বালাতে এসেচ বই তো নয়–ওরকম মুখ ঘুরিও না, ছিঃ–হা করো লক্ষ্মী–দেখি এই দলাটা হলেই হয়ে গেল–আবার ওবেলা টুলুদের বাড়িতে মনসার ভাসান হবে। তুই জানিস নে বুঝি? শিগগির শিগগির খেয়ে নিয়ে চলো। আমরা সব

দুৰ্গা বাড়ি ঢুকিল। কোথা হইতে ঘুরিয়া আসিতেছে। এক পা ধুলা, কপালের সামনে একগোছা চুল সোজা হইয়া প্রায় চার আঙুল উঁচু হইয়া আছে। সে সব সময় আপন মনে ঘুরিতেছে–পাড়ার সমবয়সি ছেলেমেয়ের সঙ্গে তাহার বড় একটা খেলা-ধুলা নাই– কোথায় কোন ঝোপে। বৈঁচি পাকিল, কাদের বাগানে কোন গাছটায় আমের গুটি বাঁধিয়াছে, কোন বাঁশতলায় শেয়াকুল খাইতে মিষ্ট-এ সব তাহার নখদর্পণে। পথে চলিতে চলিতে সে সর্বদা পথের দুই পাশে সতর্ক দৃষ্টিতে চাহিয়া দেখিতে দেখিতে চলিয়াছে—কোথাও কাঁচপোকা বসিয়া আছে কি না। যদি কোথাও কণ্টিকারী গাছের পাকা ফল দেখিতে পাইল, তৎক্ষণাৎ খেলাঘরের বেগুন করিবার জন্য তাহা তুলিতে বসিয়া যাইবে। হয়তো পথে কোথাও বসিয়া সে নানারকমের খাপরা লইয়া ছড়িয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিতেছে, গঙ্গা-যমুনা খেলায় কোনখানায় ভালো তাক হয়–পরীক্ষায় যেখানা ভালো বলিয়া প্রমাণিত হইবে, সেখানা সে সযত্নে আঁচলে বাঁধিয়া লইবে। সর্বদাই সে পুতুলের বাক্স ও খেলাঘরের সরঞ্জাম লইয়া মহাব্যস্ত।

সে ঢুকিয়া অপরাধীর দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চাহিল। সর্বজয়া বলিল—এলে! এসো, ভাত তৈরি। খেয়ে আমায় উদ্ধার করো।–তারপর আবার কোন দিকে বেরুতে হবে বেরোও। বোশেখ মাসের দিন-সকলের মেয়ে দ্যাখো গে যাও সেঁজুতি করচে, শিবপুজো করচে–আর অত বড় ধাড়ি মেয়ে–দিনরাত কেবল টো টো। সেই সকাল হতে না হতে বেরিয়েচে, আর এখন এই বেলা দুপুর ঘুরে গিয়েচে, এখন এলো বাড়ি-মাথাটার ছিরি দ্যাখো না! না একটু তেল দেওয়া, না একটু চিরুনি ছোঁয়ানো-কে বলবে বামুনের মেয়ে, ঠিক যেন দুলে কি বাগদিদের কেউ–বিয়েও হবে ওই দুলে-বাগদিদের বাড়িতেই–আচলে ওগুলো কী ধনদৌলত বাঁধা-খোল–

দুৰ্গা ভয়ে ভয়ে আঁচলের খুঁট খুলিতে খুলিতে কহিল–ওই রােয়ককাদের বাড়ির সামনে কালকাসুন্দে গাছে–পরে ঢোঁক গিলিয়া কহিল–এই অনেক বেনেবৌ তাই–

বেনেবৌয়ের কথায় হৃদয় গলে না। এমন পাষাণ জীবও জগতে অনেক আছে। সর্বজয়া তেলেবেগুনে জ্বলিয়া কহিল–তোর বেনেবৌয়ের না নিকুচি করেচে, যত ছাই আর ভাসসো রাতদিন বেঁধে নিয়ে ঘুরচেন–আজি টান মেরে তোমার পুতুলের বাক্স ওই বাঁশতলার ডোবায় যদি না ফেলি। তবে–

সর্বজয়ার কথা শেষ হইবার পূর্বেই এক ব্যাপার ঘটিল। আগে আগে ভুবন মুখুজ্যের বাড়ির সেজ-ঠাকরুন, পিছনে পিছনে তাঁহার মেয়ে টুনু ও দেওরের ছেলে সন্তু, তাহাদের পিছনে আর চার-পাঁচটি ছেলেমেয়ে সম্মুখ দরজা দিয়া বাড়ি ঢুকিল। সেজ-ঠাকরুন কোনো দিকে না চাহিয়া বাড়ির কাহারও