বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:পথের পাঁচালী.djvu/৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পথের পাঁচালী
৫৫

তাড়িয়ে দিলে—তুমি ভারি হিংসুক কিন্তু সতু দা! রাণুর মনে দুর্গার চোখের ভরসাহারা চাহনি বড় ঘা দিল।

 অপু অতশত বোঝে নাই, বেড়ার বাহিরের পথে আসিয়৷ বলিল—কোন জায়গায় বড় বড় আম রে দিদি। পুঁটুদের সল্‌তেখাগী-তলায়? কোন তলায় দুর্গা তাহা ঠিক করে নাই, একটু ভাবিয়া বলিল—চল্ গড়ের পুকুরের ধারের বাগানে যাবি—ওদিকে সব বড় বড় গাছ আছে—চল্—। গড়ের পুকুর এখান হইতে প্রায় পনেরো মিনিট ধরিয়া সুঁড়ি পথে অনবরত বন-বাগান অতিক্রম করিয়া তবে পৌঁছানো যায়। অনেক কালের প্রাচীনা আম ও কাঁঠালের গাছ—গাছতলায় বনচালতা ময়না-কাঁটা ষাঁড়া গাছের দুর্ভেদ্য জঙ্গল। দূর বলিয়া এবং জনপ্রাণীর বাসশূন্য গভীর বলেব মধ্যে বলিয়া এ সব স্থানে কেহ বড় একটা আম কুড়াইতে আসে না। কাছির মত মোটা মোটা অনেক কালের পুরানো গুলঞ্চ লতা এগাছে ওগাছে দুলিতেছে—বড় বড় প্রাচীন গাছের তলাকার বাঁটাভরা ঘন ঝোপজঙ্গল খুঁজিয়া তলায় পড়া আম বাহির করা সহজসাধ্য তো নহেই, তাহার উপর আবার ঘনায়মান নিবড়-কৃষ্ণ ঝোড়ো মেঘে ও বাগানের মধ্যের জঙ্গলে গাছের আওতায় এরূপ অন্ধকারের স্বষ্টি করিয়াছে যে, কোথায় কি ভাল দেখা যায় না। তবুও খুঁজিতে খুঁজিতে নাছোড়বান্দা দুর্গা গোট আট দশ আম পাইল!

 হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল—ওরে অপু—বৃষ্টি এল।

 সঙ্গে সঙ্গে ঝড়টা যেন খানিকক্ষণ একটু নরম হইল—ভিজে মাটির সোঁদা সোঁদা গন্ধ পাওয়া গেল—একটু পরেই মোটা মোটা ফোঁটায় চড়বড় করিয়া গাছের পাতায় বৃষ্টি পড়িতে সুরু করিল।

 —আয় আমরা এই গাছতলায় দাড়াই—এখানে বিষ্টি পড়বে না—

 দেখিতে দেখিতে চারিদিক ধোঁয়াকার করিয়া বৃষ্টি নামিল—বৃষ্টির ফোঁটা পড়িবার জোরে গাছের পাতা ছিঁড়িয়া উড়িয়া পড়িতে লাগিল—ভরপুর টাট্‌কা ভিজা মাটির গন্ধ আসিতে লাগিল। ঝড় একটু যেন নরম পড়িয়াছিল—তাহাও আবার বড় বাড়িল—দুর্গা যে গাছতল ভাসাইয়া লইয়া চলিল। বাড়ী হইতে অনেক দূর আসিয়া পড়িয়াছে—অপু ভয়ের স্বরে বলিল—ও দিদি—বড্ড যে বিষ্টি এল!

 তুষ্ট আমার কাছে আয়—দুর্গা তাহাকে কাছে আনিয়া, আঁচল দিয়া ঢাকিয়া কহিল—এ বিষ্টি আর কতক্ষণ হবে—এই ধরে গেল বলে—বিষ্টি হোলো ভালই হোলো—আমরা আবার সোনামুখী-তলায় যাবো এখন, কেমন তো?

 দুজনে চেঁচাইয়া বলিতে লাগিল—

নেবুর পাতায় করমচা,
হে বিষ্টি ধ’রে যা—

 কড়্—কড়্—কড়াৎ···প্রকাণ্ড বন-বাগানের অন্ধকার মাথাটা যেন এদিক্ হইতে ওদিক্ পর্য্যন্ত চিরিয়া