আমার বয়স যখন ১৩ বৎসর, তখন আমার পিতার পুস্তকশালায় চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতির একখানি ছাপা পুঁথি আমি পাইয়াছিলাম, ইহা ১৮৭৮ সনের কথা। পিতা ইংরেজীনবীশ এবং ব্রাহ্মধর্ম্মে আস্থাবান্ ছিলেন। সেকালের ব্রাহ্ম-মতাবলম্বীরা চৈতন্য-ধর্ম্মের, বিশেষ করিয়া বংশীধারী কৃষ্ণের বিদ্বেষী ছিলেন। তথাপি আমাদের ঢাকা জেলায় কৃষ্ণকমল গোস্বামী তাঁহার ‘রাই-উন্মাদিনী’ ও ‘স্বপ্ন-বিলাস’ যাত্রায় কৃষ্ণ-প্রেমের যে বন্যা বহাইয়া দিয়াছিলেন, তাহা তথাকার ব্রাহ্মদিগের আঙ্গিনায়ও ঢুকিয়াছিল,—পৌত্তলিকের এই বৈপ্লবিক অভিযান তাঁহাদের নিরাকার চৈতন্য-স্বরূপ ব্রহ্ম-ব্যূহ ঠেকাইয়া রাখিতে পারে নাই।
আমাদের বাড়ীতে বৈষ্ণব-ভিখারীরা আনাগোনা করিত এবং পিতামহাশয় কখনও কখনও সেই ভিখারীদের মুখে “শুন ব্রজরাজ, স্বপনেতে আজ, দেখা দিয়ে গোপাল কোথায় লুকালো” ইত্যাদি গান শুনিতে ভালোবাসিতেন। আমি সেই কিশোর বয়সে নিবিষ্ট হইয়া সারেঙ্গের সুরের সঙ্গে গায়কের কণ্ঠস্বরের আশ্চর্য্য মিল ও একতান ঝঙ্কার শুনিয়া মুগ্ধ হইতাম। সারেঙ্গ নানা লীলায়িত ছন্দোবন্ধে কখনও ভ্রমরগুঞ্জনের মত, কখন অপ্সরী-কণ্ঠ-নিন্দিত সুরে বিনাইয়া বিনাইয়া—মিষ্ট মৃদু তানে “ঋ-ঋ” করিয়া কানে মধু ঢালিয়া দিত, সেই সঙ্গে
“আহা মরি, সহচরি, হায় কি করি, কেন এ কিশোরীর সুশর্ব্বরী প্রভাত হ’ল”-
পদের “রি”গুলি যে কি অদ্ভূত সঙ্গত করিত, তাহা আমি বুঝাইতে পারিব না, মনে হইত, যেন কবি কৃষ্ণকমল কণ্ঠস্বর ও সারেঙ্গের এই অপূর্ব্ব একতান সঙ্গত করিবার জন্যই এই পঞ্চ ‘রি’-রণিত পদটি রচনা করিয়াছিলেন, গানটি যেন সারেঙ্গের মর্ম্মান্ত করুণ সুরের সঙ্গে বিলাপ করিতে থাকত।