মেজোবাবু কেন তাদের পাত্তা পাইবেন? ও কাজ হােসেন মিয়ার মতাে মানুষের পক্ষে সম্ভব, মেজোবাবুর চেয়ে বেশি টাকা উপার্জন করিয়াও যার মাঝিত্ব খসিয়া যায় নাই।
মালা? মালার কথাও মেজোবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন। মালার পায়ের যে চিকিৎসা চলিতেছিল, কী হইল তার? তারপর ফাঁকা জমিটুকুতে ঘর তুলিবার অনুমতি দিয়া কুবেরকে মেজোবাবু বিদায় দিলেন।
মালা আজও মুখ ভার করিয়া ছিল। কিন্তু কৌতূহল দমন করা যায় না।
কী কইল মাইজা কত্তা?
কী কইব? তর কথা জিগাইল।
হ?
নায় তুইলা আবার তরে হাসপাতাল নিয়া যাইব কইল গােপির মা।
গোঁয়ার কি সহজ কুবের! গোঁ ধরিলে আর তাে সে তাহা ছাড়িবে না! মেজোবাবুর নৌকায় মালা যে আমিনবাড়ি গিয়াছিল, কতকাল সে একথা মনের মধ্যে পুষিয়া রাখিবে সেই জানে, হয়তো মালা যখন বুড়ি হইয়া যাইবে, বিকল পা-টির মতাে সর্বাঙ্গ শীর্ণ হইয়া আসিবে তাহার, তখনও একথা ভুলিবে না কুবের। কলহ করিয়া মালা কাঁদে। মৃত্যু কামনা করে নিজের। কিন্তু এ বিষয়ে কুবের কঠোর, নির্মম। অন্য বিষয়ে মালার সঙ্গে তাহার ব্যবহার বদলায় না, পঙ্গু অসহায় স্ত্রীর জীবন তারই বক্ষের আশ্রয়ে আজও উথলিয়া ওঠে কিন্তু আমিনবাড়ি যাওয়ার জন্য অম্লান বদনে মালাকে সে পীড়ন করে। আজ রাত্রেই হয়তাে কুবের মালাকে বুকে জড়াইয়া মিঠা মিঠা কথা বলিবে, পদ্মার ঠাণ্ডা বাতাসে জুড়াইয়া জুড়াইয়া কি যে মধুর হইয়া উঠিবে কুবেরের ব্যবহার! কাল হয়তাে আবার সে কাঁদাইবে মালাকে মেজোবাবুর কথা তুলিয়া। এমনই প্রকৃতি পদ্মানদীর মাঝির, ভদ্রলােকের মতাে একটানা সংকীর্ণতা নয়, বিরাট বিস্তারিত সংমিশ্রণ।
ঘর তােলা শেষ হইতে দিন দশেক সময় লাগিল। তারপর একদিন বঙ্কুর সঙ্গে বিবাহ হইয়া গেল গােপির।
কপিলা আসিল বিবাহে।
সে না আসিলে বিবাহের কাজ করিবে কে? মালা তাে পঙ্গু।
কুবের খুশি হইয়া বলিতে লাগিল, আইছস কপিলা, আইছস? কুবের যেন ভুলিয়া গিয়াছে চরডাঙার পুকুরের জলে কী কথা তাহার হইয়াছিল কপিলার সঙ্গে। কিন্তু কপিলা সব মনে পড়াইয়া দেয়। সরিয়া সরিয়া পালাইয়া বেড়ায় কপিলা, ঢেঁকিঘরের ভিতরে দাঁড়াইয়া কুবের ইশারা করিয়া কাছে ডাকিলে মুখ ঘুরাইয়া থাকে। এ তাে ছলনা নয়, খেলা নয় কপিলার। কী যেন ভাবিয়া আসিয়াছে কপিলা এবার, বড়াে সে গম্ভীর। একটু হাসি, দুটি কথার কাঙাল কুবের, কপিলার হাসি কই, কথা কই কপিলার মুখে?