পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৫৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৪০
পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা

বৌদ্ধ সমাজে নারীদিগের অনেকটা স্বাধীনতা দৃষ্ট হয়। এই স্বাধীনতার প্রভাব প্রতিবেশী হিন্দু ও মুসলমান সমাজ সম্পূর্ণরূপে এড়াইতে পারে নাই। সম্ভবতঃ এইজন্য এই গানগুলিতে সামাজিক নীতির কতকটা শিথিলতা দৃষ্ট হয়। হিন্দুদের চক্ষেই ইহা বেশী বাজে। কারণ এখানে সতীত্বের কড়াকড়ি বেশী। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও বলিতে হইবে যে এই গানগুলি অতি সহজে এবং নৈসৰ্গিক ভাবের প্রেরণায় রচিত হইয়াছিল। রচকেরা সমাজের কোন ধারই ধারেন নাই। এই বন-জঙ্গলের অধিবাসীরা যেন বন-জঙ্গলের পাখীর মতই স্বাধীনভাবে স্বীয় কাকলীর দ্বারা সকলকে মোহিত করিয়াছেন। তাঁহারা ব্রাহ্মণ্য সমাজ ও হিন্দু আদর্শের কোন ধারই ধারেন নাই, অথচ অন্ততঃ বাতাসীর চরিত্র আমাদের নিকট বড়ই করুণাত্মক এবং একনিষ্ঠ প্রেমের পরিচায়ক বলিয়া মনে হইতেছে। কবি তাহার বিবাহের ইঙ্গিত মাত্র আভাস দিয়া সে প্রসঙ্গ একেবারেই ছাড়িয়া দিয়াছেন, যেন বিষয়টা তাহার জীবনের একেবারেই গুরুতর ঘটনা নহে। এখানে কবি প্রেমকেই সর্ব্বাপেক্ষা বড় করিয়া দেখাইয়াছেন। বিবাহ, সতীত্ব-ধর্ম্ম, সামাজিক নিন্দা-প্রশংসা এসকল যেন অতি তুচ্ছ বিষয়। প্রাসঙ্গিক ভাবেও এ সম্বন্ধে কবি কিছু বলেন নাই। বাতাসীর অনুরাগ একনিষ্ঠ। সে যখন নদীর তীরে চোখের জল মুছিতে মুছিতে তাহার নায়ককে বিদায় দিতেছে, আমাদের সেই চিত্রই মনে পড়ে। যেখানে বাতাসী জলে নিমজ্জিত মুমুর্ষূ নায়কের মস্তক ক্রোড়ে ধারণ করিয়া প্রেমের প্রথম সুরের মোহিনী মুগ্ধ হইয়া তাহার সেবা করিতেছে, আমাদের সেই চিত্রই মনে পড়ে। অবশেষে যেখানে সে তাহার প্রাণাপেক্ষা প্রিয় বিনাথের মৃত্যুতে একেবারে সমস্ত সংযম হারাইয়া আত্মহত্যা করিতেছে, সেই পদ্মার স্রোতের ন্যায় দুৰ্দ্ধমনীয় প্রেমের তরঙ্গই আসিয়া তখন আমাদের হৃদয়ে অভিঘাত করে। সেই শেষ চিত্রের করুণরস উপলব্ধি করিতে করিতে যখন আমরা পালাটি সাঙ্গ করি তখন সমস্ত দৃশ্য, সমস্ত ঘটনা, সুমাই ওঝার অসাধারণ মন্ত্রশক্তি এবং ভীষণ ষড়যন্ত্র—এ সমস্ত ছাপাইয়া এই পতিদ্রোহী সমাজনিন্দিতা বাতাসীর ছবিটিই আমাদের মানসচক্ষে উজ্জ্বল হইয়া উঠে। এই সকল পালাগানে সমাজের, ধর্ম্মের,