পাতা:প্রকৃতি বনাম মানুষঃ একটি পরিকল্পিত সংঘাত - মাধব গাডগিল.pdf/১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আদায় করাও চলেছে সমান তালে। এরা বিত্তবান ও ক্ষমতাশালী মানুষদের, চা কফি এস্টেটের মালিকদের পক্ষপাতিত্ব করার পাশাপাশি রেল কোম্পানি ও রেয়ন সুতোর কল এবং কাগজ মিলের মতো বনজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল কোম্পানিদেরও পক্ষপাতিত্ব করত।

 সেলিম আলী

 স্বাধীন ভারতবর্ষে, বন ও বন্যপ্রাণ ব্যবস্থাপনা নীতিগুলি নির্মাণের একজন মুখ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন সেলিম আলী। উনি ছিলেন আমার বাবার বন্ধু। আমার ১৪ বছর বয়সে ওনার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। ওনার জ্ঞান, স্ফুর্তি, কৌতুক, উদ্দীপনায় মুগ্ধ হয়েই আমিও ফিল্ড ইকোলজিস্ট (মাঠেঘাটে-ঘোরা পরিবেশবিদ) হব বলে মনস্থির করেছিলাম। আমার বাবা ১৯৩০এর দশকের শুরু থেকেই বম্বে ন্যাচরাল হিস্ট্রি সোসাইটি (BNHS)-র সদস্য ছিলেন। ১৯৬৩ সালে আমার জন্মদিনে আমায় সেখানকার আজীবন সদস্যপদ উপহার দিয়েছিলেন বাবা। তাই সেলিম আলীর সঙ্গে দীর্ঘ তিন দশক ধ’রে ১৯৫৬ থেকে ১৯৮৬ অবধি, ৯০ বছর বয়সে, ওঁর মৃত্যু পর্যন্ত, বহু ফিল্ড ট্রিপে, BNHS-এ আমি প্রচুর সময় কাটিয়েছি। দলবদ্ধভাবে দাঁড়ে ব’সে পাখিদের বিশ্রামের অভ্যেস নিয়ে ওঁর সঙ্গে গবেষণাপত্র প্রকাশ করার সৌভাগ্যও আমার হয়েছে। একসময় উনি আমায় বলেছিলেন— বহু মানুষখেকো বাঘ আছে, কিন্তু খুব অল্পসখ্যক বাঘ-খেকো মানুষদের মধ্যে, উনিও একজন। উনি আর ওঁর সুহৃদ ও সঙ্গী ডিলান রিপ্লে খাসি পাহাড়ে বাঘ মেরে তার স্টেক খেয়েছিলেন।

 সেলিম আলীর সবচেয়ে প্রিয় আসক্তি ছিল শিকার এবং মাঠে-ময়দানে পাখি সম্পর্কে বিস্তৃত চর্চা। খুব ছোটো বয়স থেকেই উনি পাখিদের সম্পর্কে খুব সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ডাইরিতে লিখে রাখতেন। বছর দশেক বয়সে এয়ারগান দিয়ে উনি একটা চড়াই পাখি মেরেছিলেন। এই ঘটনাটিই ওনাকে পাখির প্রতি উৎসাহিত ক’রে তুলেছিল। কারণ সেটা সাধারণ চড়াই ছিল না, ছিল একটা হলুদ গলা চড়াই। চড়াইটাকে উনি BNHS-এ নিয়ে যান, যে BNHS ১৮৮৩ সালে ব্রিটিশ প্রকৃতিবিদ, সরকারী কর্তাব্যক্তি আর চা কফি এস্টেট মালিকদের নিয়ে তৈরি হয়েছিল। সেখানে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সমস্ত তত্ত্বাবধায়করা ছিলেন ব্রিটিশ। ১৯০৬ সালে ১০ বছর বয়সে তিনি প্রথম BNHS-এর সান্নিধ্যে এলে, এই সমস্ত মানুষই তাঁকে প্রভাবিত করেছিলেন। ধাঁচা হিসেবে BNHS হল রয়্যাল সোসাইটি অফ বার্ডস-এর মতো। এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন ডব্যু এইচ হাডসন। তিনি আর্জেণ্টিনায় বন্য জানোয়ারদের মতো আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদেরও শিকার করতেন। হাডসনের রয়্যাল সোসাইটি অফ বার্ডস এমন একটা সোসাইটি যা সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা এবং সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষেই কাজ করত, যেমন BNHS কাজ করত অভিজাতদের পক্ষে।

 সেলিম আলী ৩২ বছর বয়সে জার্মানীতে আরউইন স্ট্রেসম্যানের কাছে পক্ষীবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলেন। সেইসময় আরউইন ছিলেন বিশ্বের অন্যতম পক্ষীবিদ। ফিরে এসেই তিনি BNHS-এর জার্নালে গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন। এই প্রবন্ধগুলির মধ্যে দু’টিতে তিনি মুঘল সম্রাটদের প্রকৃতিবিদ এবং খেলোয়াড় ওরফে শিকারি হিসেবে দেখিয়েছেন। এটি নিঃসন্দেহে শিকারের প্রতি তাঁর ভালোবাসার পরিচায়ক এবং স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক অবস্থায় বন্যপ্রাণীদের খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করারও ইঙ্গিতবাহী। ভারতীয় রাজপুত্ররা সবাই শিকার করতে ভালোবাসতেন। তারা যে প্রাণী ও পাখি শিকার করতেন, সেসব বন্যপ্রাণ নিয়ে তারা যথেষ্ট উৎসাহীও ছিলেন। সেলিম আলী মাইসোর, কোচিন, ত্রিবাঙ্কুর,

10