পাতা:প্রকৃতি বনাম মানুষঃ একটি পরিকল্পিত সংঘাত - মাধব গাডগিল.pdf/১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

চাইলে ড্রাইভার সেখানেও থামতে অস্বীকার করে। হোটেলের ভেতর কার্যত তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখা হয় প্রহরী সমেত। সেই প্রহরী হোটেলের বাইরে বাজারে যাবার জন্যও দরজা খুলে দিতে অস্বীকার করে। সংরক্ষিত ক্রীড়াঙ্গনের গা ঘেঁষা একটা বিপুল পরিমাণ জমির মালিক হল ঐ ইউরোপীয় পর্যটন সংস্থা। পার্কের ভিতরের সমস্ত পর্যটনই সম্পূর্ণভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন। রীতিমতো উদ্যোগ নিয়ে স্থানীয়দের সাথে যোগাযোগ এড়িয়ে যাবার কারণ হয়তো, স্থানীয় মানুষ অত্যন্ত অসন্তুষ্ট। এই পার্কের নাম মাসাই-এর মানুষদের নামে হলেও, রিজার্ভটি স্থাপন করার জন্য এই এলাকার প্রকৃত পূর্বপুরুষ, মাসাইদের জোর করে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, তাদের দেশজ জমি থেকে উৎখাত করা হয়েছিল। আফ্রিকার অন্য দেশগুলিতে ক্রীড়া খামার রয়েছে, যেমন বারকিনা ফাসোতে নাজিংগা ক্রীড়া খামার।১২ আবারও এই ক্রীড়া খামারগুলোর মালিক এবং পরিচালক ইউরোপীয়রাই। এই ক্রীড়া খামারগুলোতে পর্যটকরা হাতি ও অন্যান্য প্রাণী শিকার করতে পারে এবং শিকার স্মারক নিয়ে ব্রিট্রেন, আমেরিকা এবং অন্যান্য দেশে ফিরে যায়। ২০০৫ থেকে ২০১৪-এই ১০ বছরে তুষার হংস বা স্নো গুজ থেকে শুরু ক’রে আমেরিকার কালো ভাল্লুক থেকে সিংহ, হাতি, গণ্ডার, ইম্পালা এবং হরিণ মেরে স্মারক-শিকারিরা কানাডা এবং আফ্রিকা থেকে ১২.৬ লক্ষ শিকার-স্মারক আমদানি করেছে আমেরিকায়। এটাই ব্রিটেনেও চলে, তবে আমেরিকার চেয়ে কম মাত্রায়। অতএব ১৯৭২ থেকে ভারতে যখন সমস্ত বন্য পাখি এবং স্তন্যপায়ীদের শিকার নিষিদ্ধ হয়েছে, তখন ব্রিটেন বা আমেরিকায় কিন্তু কোনো সংযম বা নিয়ন্ত্রণ দেখা যায়নি।

 WLPA ন্যাশনল পার্কের যে ধাঁচা দিয়েছিল, তা আদতে আমেরিকার ন্যাশনল পার্কের মডেল। আমেরিকার ন্যাশনল পার্কের ইতিহাস বেশ শিক্ষণীয়। ইউরোপ থেকে উত্তর আমেকিয়ার আসা বসতি স্থাপকেরা পূর্ব থেকে পশ্চিমে এসেছিলেন, তারা জঙ্গল ধ্বংস করেছিলেন এবং অসংখ্য বন্যজন্তুদের স্রেফ মুছে ফেলেছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে লাখ লাখ বাইসন এবং কোটি কোটি যাত্রী পায়রা বা প্যাসেঞ্জার পিজয়ন। এই মহাদেশে ইউরোপীদের বিজয়যাত্রা শেষ হবার পর দেশীয় মানুষদের সামান্য কিছু সংরক্ষিত অঞ্চলে ঠেলে দেওয়া হল। তখনই, বন্যতার সৌন্দর্য্য সম্পর্কে ইউরোপীয়দের চোখ খুলে গেল, তারা সচেতন হল। এই উদ্বেগ থেকেই ইয়লোস্টোন এবং অন্যান্য ন্যাশনল পার্কের প্রতিষ্ঠা। দাবি করা হলেও আমেরিকার ইয়লোস্টোন কিন্তু পৃথিবীর প্রথম সংরক্ষিত অরণ্য নয়। এই মুকুটটির অধিকারী মঙ্গোলিয়ার বোগ খান পর্বত, যাকে প্রাথমিকভাবে সেখানকার মানুষ এবং তারপর ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে সেখানকার সরকার পবিত্র পর্বত হিসেবে সংরক্ষিত ক'রে আসছেন। ভারতেরও বেশ কয়েকটি পবিত্র পর্বত রয়েছে, যেমন কেরালার শবরীমালা, কর্ণাটকের গোপালস্বামী বেট্টা, হিমালয়ের বদ্রীনাথ। কিন্তু কোনো শাসকই এগুলিকে সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেননি।

 সংরক্ষণের প্রতিমূর্তি বাঘ

 যে বাঘকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক মুনাফাসহ দিব্যি আনন্দে ফুর্তিতে শিকার করত ধনী ও ক্ষমতাশালীরা, বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার পর হঠাৎ করেই অন্য আরেক গুচ্ছ ধনী এবং ক্ষমতাশালী মানুষদের প্রকৃতিভিত্তিক, বাঘকেন্দ্রিক মুনাফার জন্য সেই বাঘকেই সংরক্ষণের প্রতিমূর্তি (আইকন)-তে পরিণত করা হল। যারা বাঘকে শিকারে রূপান্তরিত প্রাণী হয়ে যাওয়া থেকে যে কোনো মূল্যে সংরক্ষণের প্রতিমূর্তি রূপে প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত ছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম সক্রিয় সদস্য ছিলেন বম্বে ন্যাচরাল হিস্ট্রি সোসাইটির বেশ প্রভাবশালী

17