পাতা:প্রবন্ধ সংগ্রহ - প্রমথ চৌধুরী.pdf/১১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SOV প্রবন্ধসংগ্ৰহ সতরাং রবীন্দ্রনাথের অন্যাকরণে এবং অনাসরণে যে কাব্যসাহিত্য রচিত হয়েছে, তা নকল সাহিত্য বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। এই নবকবিদের রচনার প্রতি দল্টিপাত করলে প্রথমেই নজরে পড়ে যে, এ-সকল রচনা ভাষার পারিপাট্যে এবং আকারের পরিচিছন্নতায় পবদ্যাগের কবিতার অপেক্ষা অনেক শ্রেষ্ঠ। যেমন কেবলমাত্ৰ মনের আনন্দে গান গাইলে তা সংগীত হয় না, তেমনি কেবলমাত্ৰ মনের আবেগে সবচছন্দে লিখে গেলেও তা কবিতা হয় না। মনের ভাবকে ব্যক্ত করবার ক্ষমতার নামই রচনাশক্তি। মনের ভাবকে গড়ে না। তুলতে পারলে তা মতিধারণ করে না, আর যার মতি নেই তা অপরের দটির বিষয়ীভূত হতে পারে না। কবিতা শব্দকায় । ছন্দ মিল ইত্যাদির গণেই সে কায়ার রূপ ফটে ওঠে। মনোভাবকে তার অন্যরােপ দেহ দিতে হলে শব্দজ্ঞান থাকা চাই, ছন্দমিলের কান থাকা চাই। এ জ্ঞান লাভ করবার জন্য সাধনা চাই, কেননা সাধনা ব্যতীত কোনো আটো কৃতিত্ব লাভ করা যায় না। নবকবিরা যে সে-সাধনা করে থাকেন তার কারণ এ ধারণা তাঁদের হৃদয়ঙ্গম হয়েছে যে, লেখা জিনিসটে একটা আট। নবীন কবিদের রচনার সহিত হেমচন্দ্রের ‘কবিতাবলী’ কিংবা নবীনচন্দ্রের ‘অবকাশরঞ্জিনী’র তুলনা করলে নবযাগের কবিতা পােব যাগের কবিতার অপেক্ষা আট-অংশে যে কত শ্রেষ্ঠ তা সপভটই প্রতীয়মান হবে। শব্দের সম্পপদে এবং সৌন্দযে, গঠনের সৌম্ঠবে এবং সষমায়, ছন্দে ও মিলে, তালে ও মানে এ শ্রেণীর কবিতা সাহিত্যের ইভলিউশনের এক ধাপ উপরে উঠে গেছে। এ স্থলে হয়তো পবিপক্ষ এই আপত্তি উত্থাপন করবেন যে, ভাবের অভাব থেকেই ভাষার এই-সব কারিগরি জন্মলাভ করে। যে কবিতার দেহের সৌন্দৰ্য নেই, তার যে আত্মার ঐশবয আছে, এ কথা আমি সস্বীকার করতে পারি নে। এলোমেলো ঢিলেঢালা ভাষার অন্তরে ভাবের দিব্যমতি দেখবার মতো অন্তদন্টি আমার নেই। প্রচ্ছন্ন মতি ও পরিচিচ্ছন্ন মতি এক রূপ নয়। ভাব যে কাব্যের আত্মা এবং ভাষা তার দেহ, এ কথা আমি স্বীকার করি। কিন্তু কাব্যের দেহ থেকে আত্মা পথক করা অসম্পভব বললেও অত্যুক্তি হয় না। কোথায় দেহের শেষ হয় এবং আত্মার সত্ৰপাত হয়, সে সন্ধান কোনো দার্শনিকের জানা নেই। যাঁর রসজ্ঞান আছে তাঁর কাছে এ-সব তকের কোনো মাল্য নেই। কবিতা-রচনার আর্ট নবীন কবিদের অনেকটা করায়ত্ত হয়েছে, এ কথা যদি সত্য হয় তা হলে তাঁদের লতাজা পাবার কোনো কারণ নেই। ভারতচন্দ্ৰ মালিনীর বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে আছিল বিস্তর ঠাট প্রথম বয়েসে। এবে বাড়া তব কিছ গড়া আছে শেষে। স্বয়ং ভারতচন্দ্রের কবিতার যদি ঠাট বাদ দেওয়া যায়, তা হলে যে গড়া অবশিষ্ট থাকে তাতে ফোঁটা দেওয়াও চলে না, কেননা সে গড়া চন্দনের নয়। অথচ ভারতচন্দ্ৰ যে কবি, সে বিষয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। নবীন কবিদের যে ভাবসম্পদ নেই, এ কথা বলায়, আমার বিশবাস, কেবলমাত্র অন্যমনস্কতার পরিচয় দেওয়া হয়। মহাকবি ভাস বলেছেন যে, পথিবীতে ভালো কাজ করবার লোক সলভ, চেনবার লোকই দলভ।