পাতা:প্রবন্ধ সংগ্রহ - প্রমথ চৌধুরী.pdf/২৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

RRO প্ৰবন্ধসংগ্ৰহ নেই। সংস্কৃত নাটকে বিদষকদের রসালাপ শনে আমাদের হাসি পায়, কিন্তু সে তাদের কথায় হাস্যরসের একান্ত অভাব দেখে। ও হচেছ পেটের দায়ে রসিকতা। বাংলার প্রাচীন কবির কেউ এ রিসে বণ্ডিত নন। শািন্ধ ভারতচন্দ্রের লেখায় এটি বিশেষ করে। ফটেছে। ভারতচন্দ্র এ কারণেও বহ সাধ ব্যক্তিদের কাছে অপ্রিয়। হাস্যরস যে অনেক ক্ষেত্রে শলীলতার সীমা লঙ্ঘন করে, তার পরিচয় আরিস্টফেনিস থেকে আরম্ভ করে আনাতোেল ফ্রাঁস পর্যন্ত সকল হাস্যরসিকের লেখায় পাবেন। এর কারণ হাসি জিনিসটেই অশিম্পট, কারণ তা সামাজিক শিক্ষাটাচারের বহির্ভূত। সাহিত্যের হাসি শােধ মাখের হাসি নয়, মনেরও হাসি। এ হাসি হচ্ছে সামাজিক জড়তার প্রতি প্ৰাণের বক্ৰোন্তি, সামাজিক মিথ্যার প্রতি সত্যের বক্ৰদস্পিট। ভারতচন্দ্রের কাব্য যে অশলীলতাদোষে দলেট সে কথা তো সকলেই জানেন, কিন্তু তাঁর হাসিও নাকি জঘন্য। সন্দরের যখন রাজার সমখে বিচার হয় তখন তিনি বীরসিংহ রায়কে যে-সব কথা বলেছিলেন তা শনে জনৈক সমালোচকমহাশয় বলেছিলেন যে, শবশরের সঙ্গে এহেন ইয়ারকি কোন সমাজের সরীতি ? আমিও জিজ্ঞাসা করি, এরােপ সমালোচনা কোন সাহিত্যসমাজের সরীতি ? এর নাম ছেলেমি না জ্যাঠাম ? তাঁর নারীগণের পাতনিন্দাও দেখতে পাই অনেকের কাছে নিতান্ত অসহ্য। সে নিন্দার অশলীলতা বাদ দিয়ে তার বিদ্রপেই নাকি পরিষের প্রাণে ব্যথা লাগে। নারীর মাখে পতিনিন্দার সাক্ষাৎ তো ভারতচন্দ্রের পববতী অন্যান্য কবির কাব্যেও পাই। এর থেকে শােধ এই প্রমাণ হয় যে, বঙ্গদেশের সত্ৰীজাতির মাখে পতিনিন্দা এষো ধমঃ সনাতনঃ । এ স্থলে পরিষজাতির কিং কতব্য ? হাসা না কাঁদা ? বোধ হয়। কাঁদা, নচেৎ ভারতের হাসিতে আপত্তি কি! আমি উত্তজাতীয় স্বামী-দেবতাদের সমরণ করিয়ে দিই যে, দেবতার চোখে পলকও পড়ে না, জলও পড়ে না। আমাদের দেবদেবীর পরাণকলিপিত চরিত্র, অর্থাৎ সবগের রপেকথা, নিয়ে, ভারতচন্দ্ৰ পরিহাস করেছেন। এও নাকি তাঁর একটি মহা অপরাধ। এ যাগের ইংরেজিশিক্ষিত সম্প্রদায় উক্ত রপেকথায় কি এতই আস্থাবান যে উক্ত পরিহাস তাঁদের অসহ্য ? ভারত-সমালোচনার যে ক'টি নমনা দিলাম। তাই থেকেই দেখতে পাবেন যে, অনেক সমালোচক কোন রসে একান্ত বঞ্চিত। আশা করি, যে হাসতে জানে না। সেই যে সাধপরিষ ও যে হাসাতে পারে সেই যে ইতার, এহেন অদ্ভুত ধারণা এ দেশের লোকের মনে কখনো স্থান পাবে না। আমি লোকের মাখের হাসি কেড়ে নেওয়াটা নশংসতা মনে করি। আমি আর-একটা কথা আপনাদের কাছে নিবেদন করেই এ যাত্রা ক্ষান্ত হব } এ দেশে ইংরেজের শভোগমনের পর্বে বাংলাদেশ বলে যে একটা দেশ ছিল, আর সে দেশে যে মানষে ছিল, আর সে মানষের মাখে। যে ভাষা ছিল, আর সে ভাষায় যে সাহিত্য রচিত হত, এই সত্য আপনাদের সমরণ করিয়ে দেওয়াই এই নাতিহাসৰ প্রবন্ধের মােখ্য উদ্দেশ্য। কেননা ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে এ সত্য বিস্মত হওয়া আমাদের পক্ষে সহজ, যেহেতু আমাদের শিক্ষাগারদের মতে বাঙালি জাতির জন্মতারিখ হচেছ ১৭৫৭ খাস্টােব্দ।