পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 - প্রবাসী । , - -l.-്.-- হারান কহিলেন—“কিন্তু যারা যোগ্য হয়েচেন তারা ইংরেজের কাছে যথেষ্ট সমাদর পেয়ে থাকেন।--যেমন এর সকলে ।” গোরা। একজনের সমাদরের দ্বারা অন্য সকলের অনাদরটা যেখানে বেশি করে ফুটে ওঠে সেখানে এরকম সমাদরকে আমি অপমান বলে গণ্য করি। দেখিতে দেখিতে হারান বাবু অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয় উঠিলেন, এবং গোরা তাহাকে রহিয়া রহিয়া বাক্যশেলবিদ্ধ করিতে লাগিল। দুই পক্ষে এইরূপে যখন তর্ক চলিতেছে স্বচরিতা টেবিলের প্রাস্তে বসিয়া পাথার আড়াল হইতে গোরাকে একদৃষ্টিতে লক্ষ্য করিয়া দেখিতেছিল। কি কথা হইতেছে তাহা তাহার কানে আসিতেছিল বটে কিন্তু তাহাতে তাহার মন ছিল না। স্বচরিতা যে গোরাকে অনিমেষনেত্ৰে দেখিতেছে সে সম্বন্ধে তাহার নিজের যদি চেতন থাকিত তবে সে লজ্জিত হইত কিন্তু সে যেন আত্মবিস্তৃত হইয়াই গোরাকে নিরীক্ষণ করিতেছিল। গোরা তাহার বলিষ্ঠ দুই বাহু টেবিলের উপরে রাখিয়া সম্মুখে ঝুকিয়া বসিয়াছিল ; তাহার প্রশস্ত শুভ্র ললাটের উপর বাতির আলো পড়িয়াছে ; তাহার মুখে কখনো অবজ্ঞার হান্ত কখনো বা ঘৃণার ক্রকুট তরঙ্গিত হইয়া.উঠতেছে ; তাহার মুখের প্রত্যেক ভাবলীলায় একটা আত্মমৰ্য্যাদার গৌরব লক্ষিত হইতেছে ; সে যাহা বলিতেছে তাহা যে কেবলমাত্র সাময়িক বিতর্ক বা আক্ষেপের কথা নহে, প্রত্যেক কথা যে তাহার অনেক দিনের চিন্তা এবং ব্যবহারের দ্বারা নিঃসন্দিগ্ধরূপে গঠিত হইয়া উঠিয়াছে এবং তাহার মধ্যে যে কোনো প্রকার দ্বিধা দুৰ্ব্বলতা বা আকস্মিকতা নাই তাহা কেবল তাহার কণ্ঠস্বরে নহে, তাহার মুখে এবং তাহার সমস্ত শরীরেই যেন দৃঢ়ভাবে প্রকাশ পাইতেছে। স্বচরিতা তাহাকে বিস্মিত হইয় দেখিতে লাগিল। স্বচরিত তাহার জীবনে এতদিন পরে এই প্রথম একজনকে একটি বিশেষ মানুষ একটি বিশেষ পুরুষ বলিয়া যেন দেখিতে পাইল। তাহাকে আর দশজনের সঙ্গে মিলাইয়া দেখিতে পারিল না। এই গোরার বিরুদ্ধে দাড়াইয়া হারান বাবু অকিঞ্চিৎকর হইয়া পড়িলেন। তাহার শরীরের এবং মুখের আকৃতি, তাহার হাব ভাব ভঙ্গী, এমন [ ৮ম,ভাগ । কি, তাহার জামা এবং তাহার চাদরখানা পৰ্য্যস্ত যেন র্তাহাকে ব্যঙ্গ করিতে লাগিল। এতদিন বারম্বার বিনয়ের সঙ্গে গোরার সম্বন্ধে আলোচনা করিয়া সুচরিতা গোরাকে একটা বিশেষ দলের একটা বিশেষ মতের অসামান্ত লোক বলিয়া মনে করিয়াছিল, তাহার দ্বারা দেশের একটা কোনো বিশেষ মঙ্গল উদ্দেশু সাধিত হইতে পারে এইমাত্র সে কল্পনা করিয়াছিল—আজ মুচরিতা তাহার মুখের দিকে একমনে চাহিতে চাহিতে সমস্ত দল, সমস্ত মত, সমস্ত উদ্দেশু হইতে পৃথক্ করিয়া গোরাকে কেবল গোরা বলিয়াই যেন দেখিতে লাগিল। চাদকে সমুদ্র যেমন সমস্ত প্রয়োজন সমস্ত ব্যবহারের অতীত করিয়া দেখিয়াই অকারণে উদ্বেল হইয়া উঠিতে থাকে, সুচরিতার অন্তঃকরণ আজ তেমনি সমস্ত ভুলিয়া তাহার সমস্ত বুদ্ধি ও সংস্কার, তাহার সমস্ত জীবনকে অতিক্রম করিয়া যেন চতুর্দিকে উচ্ছসিত হইয়া উঠিতে লাগিল। মানুষ কি, মানুষের আত্মা কি, স্বচরিতা এই তাহ প্রথম দেখিতে পাইল এবং এই অপূৰ্ব্ব অনুভূতিতে সে নিজের অস্তিত্ব একেবারে বিস্তুত হইয়া গেল । হারান বাবু স্বচরিতার এই তদগত ভাব লক্ষ্য করিয়াছিলেন। তাহাতে র্তাহার তর্কের যুক্তিগুলি জোর পাইতেছিল না। অবশেষে একসময় নিতান্ত অধীর হইয়া তিনি আসন ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িলেন এবং স্বচরিতাকে নিতান্ত আত্মীয়ের মত ডাকিয়া কহিলেন—“স্বচরিতা, একবার এঘরে এস, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।" স্বচরিতা একেবারে চমকিয়া উঠিল। তাহাকে কে য়েন মারিল। হারান বাবুর সহিত তাহার যেরূপ সম্বন্ধ তাঙ্গাতে তিনি যে কখনো তাহাকে এরূপ আহবান করিতে পারেন না তাহা নহে, অন্ত সময় হইলে সে কিছু মনেই করিত না কিন্তু আজ গোরাও বিনয়ের সম্মুখে সে নিজেকে অপমানিত বোধ করিল। বিশেষতঃ গোরা তাহার মুখের দিকে এমন একরকম করিয়া চাহিল যে সে হারান বাবুকে ক্ষমা করিতে পারিল না। প্রথমটা, সে যেন কিছুই শুনিতে পায় নাই অমনিভাবে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। হারান বাবু তখন কণ্ঠস্বরে একটু বিরক্তি প্রকাশ করিয়া কছিলেন—“শুনচ স্বচরিত, আমার একটা কথা আছে, একবার এঘরে আসতে হবে!” ১ম সংখ্যা। ] স্বচরিতা তাহার মুখের দিকে না তাকাইয়াই কহিল— “এখন থাকৃ—বাবা আস্বন, তার পরে হবে।” বিনয় উঠিয়া কহিল—“আমরা না হয় যাচ্চি।” মুচরিতা তাড়াতাড়ি কহিল—“না বিনয় বাবু, উঠবেন না। বাবা আপনাদের থাকতে বলেচেন। তিনি এলেন বলে!”—তাহার কণ্ঠস্বরে একটা ব্যাকুল অনুনয়ের ভাব প্রকাশ পাইল । হরিণীকে যেন ব্যাধের হাতে ফেলিয়া ধাইবার প্রস্তাব হইয়াছিল। “আমি আর থাকতে পারচিনে, আমি তবে চলুম।” বলিয়া হারান বাবু দ্রুতপদে ঘর হইতে চলিয়া গেলেন। রাগের মাথায় বাহির হইয়া আসিয়া পরক্ষণেই তাহার অনুতাপ হইতে লাগিল কিন্তু তখন ফিরিবার আর কোনো উপলক্ষ্য খুঁজিয়া পাইলেন না। হারান বাবু চলিয়া গেলে স্বচরিতা একটা কোন সুগভীর লজ্জায় মুখ যখন রক্তিম ও নত করিয়া বসিয়াছিল, কি করিবে কি বলিবে কিছুই ভাবিয়া পাইতেছিল না—সেই সময়ে গোরা তাহার মুখের দিকে ভাল করিয়া চাহিয়া লইবার অবকাশ পাইয়াছিল। গোরা শিক্ষিত মেয়েদের মধ্যে যে ঔদ্ধত্য যে প্ৰগলভতা কল্পনা করিয়া রাথিয়াছিল স্বচরিতার মুখশ্ৰীতে তাহার আভাসমাত্র কোথায় ? তাহার মুখে বুদ্ধির একটা উজ্জ্বলতা নিঃসন্দেহ প্রকাশ পাইতেছিল কিন্তু নম্রতা ও লজ্জার দ্বারা তাহা কি মুন্দর কোমল হইয়া আজ দেখা দিয়াছে! মুখের ডেলটি কি স্বকুমার! ক্রযুগলের উপরে ললাটটি যেন শরতের আকাশখণ্ডের মত নিৰ্ম্মল ও স্বচ্ছ! ঠোট দুটি চুপ করিয়া আছে,কিন্তু অনুচ্চারিত কথাৰ মাধুর্য সেই দুটি ঠোঁটের মাঝখানে যেন কোমল একটি কুঁড়ির মত রহিয়াছে ! নবীন রমণীর বেশভূষার প্রতি গোরা পূৰ্ব্বে কোনো দিন ভাল করিয়া চাহিয়া দেখে নাই এবং না দেখিয়াই সে-সমস্তের প্রতি তাহার একটা ধিক্কার ভাব ছিল—আজ স্বচরিতার দেহে তাহার নূতন ধরণের শাড়ি পরার ভঙ্গী তাহার একটু বিশেষভাবে ভাল লাগিল,— স্বচরিতার একটি হাত টেবিলের উপরে ছিল—তাহার, জামার আস্তিনের কুঞ্চিত প্রাস্ত হইতে সেই হাতখানি আজ গোরার চোখে কোমল হৃদয়ের একটি কল্যাণপুর্ণ বাণীর মত বোধ হইল। দীপালোকিত শাস্ত সন্ধ্যায় স্নচরিতাকে গোরা। & বেষ্টন করিয়া সমস্ত ঘরটি তাহার আলো, তাহার দেয়ালের ছবি, তাহার গৃহসজ্জা, তাহার পরিপাট্য লইয়া একটি যেন বিশেষ অথও রূপ ধারণ করিয়া দেখা দিল। তাহা যে গৃহ, তাহ যে সেবাকুশল নারীর যত্নে স্নেহে সৌন্দর্ঘ্যে মণ্ডিত, তাহা যে দেয়াল ও কড়ি বরগা ছাদের চেয়ে অনেক বেশি–ইহা আজ গোরার কাছে মুহূর্বের মধ্যে প্রতাক্ষ হইয়া উঠিল। গোরা আপনার চতুর্দুিকের আকাশের মধ্যে একটা সজীব সত্তা অনুভব করিল—তাহার হৃদয়কে চারিদিক হইতেই একটা হৃদয়ের হিল্লোল আসিয়া আঘাত করিতে লাগিল ; একটা কিসের নিবিড়ত তাহাকে যেন বেষ্টন করিয়া ধরিল। এরূপ অপূৰ্ব্ব উপলব্ধি তাহার জীবনে কোনো দিন ঘটে নাই। দেখিতে দেখিতে ক্রমশই সুচরিতার কপালের ভ্রষ্ট কেশ হইতে তাহার পায়ের কাছে শাড়ির পাড়টুকু পৰ্য্যস্ত অত্যন্ত সত্য এবং অত্যন্ত বিশেষ হইয় উঠিল। একইকালে সমগ্রভাবে স্বচরিতা, এবং স্বচরিতার প্রত্যেক অংশ স্বতন্ত্রভাবে গোরার দৃষ্টিকে আকর্ষণ করিতে লাগিল। - কিছুক্ষণ কেহ কোনো কথা কহিতে না পারিয়া সকলেই একপ্রকার কুষ্ঠিত হইয় পড়িল। তখন বিনয় স্বচরিতার দিকে চাহিয়া কহিল—“সেদিন আমাদের কথা হচ্ছিল” বলিয়া একটা কথা উত্থাপন করিয়া দিল। • সে কহিল—“আপনাকে ত বলেইচি আমার এমন একদিন ছিল যখন আমার মনে বিশ্বাস ছিল আমাদের দেশের জন্তে সমাজের জন্তে আমাদের কিছুই আশা করবার নেই—চিরদিনই আমরা নাবালকের মত কাটাব এবং ইংরেজ আমাদের অছি নিযুক্ত হয়ে থাকবে—যেখানে যা যেমন আছে সেই রকমই থেকে যাবে—ইংরেজের প্রবল শক্তি এবং সমাজের প্রবল জড়তার বিরুদ্ধে আমাদের কোথাও কোনো উপায়মাত্র নেই। আমাদের দেশের অধিকাংশ লোকেরই এই রকম মনের ভাব। এমন অবস্থায় মানুষ, হয় নিজের স্বার্থ নিয়েই থাকে; নয় উদাসীনভাবে কাটায়। আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত লোকেরা এই কারণেই চাকরির উন্নতি ছাড়া আর কোনো কথা ভাবে না, ধনীলোকেরা গবমেন্টের খেতাব পেলেই জীবন সার্থক বোধ করে—আমাদের জীবনের যাত্রাপথটা অল্প একটু দূরে