পাতা:প্রবাসী (ত্রয়স্ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সেকালে পণ্ডিতের আদর ঐচিন্তাহরণ চক্রবর্তী দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ এবং বিস্তৃতিসাধন অনেক পরিমাণে নির্ভর করে দেশের বৈষয়িক সম্প্রদায়ের সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতার উপর। দেশের মধ্যে যাহারা সম্পন্ন তাহদের আন্তরিক উৎসাহ ও সাহায্য পাইলে তবেই দেশের পণ্ডিতসমাজ নিশ্চিন্তমনে ও সাগ্রহে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোচনায় মনোনিবেশ করিতে পারেন। এক দিকে উদরামসংস্থানের জন্য প্রাণান্তকর চেষ্ট এবং অন্য দিকে দেশের জনসাধারণের – বিশেষ করিয়া বৈষয়িক সমাজের অবজ্ঞা, উপেক্ষ বা অনুগ্রহদৃষ্টিপাত– এই উভয়ের মধ্যে পড়িয়া যেখানে শিক্ষিত সমাজকে অশাস্ত ও অস্থির হইয় উঠতে হয় সেখানে প্রকৃত পাণ্ডিত্যের আশা খুবই কম। বড়ষ্ট দুর্ভাগ্য ও দুঃখের বিষয় এই যে, আমাদের দেশে বর্তমান কালে পণ্ডিতমণ্ডলীর অবস্থা অনেকট এইরূপ--তাই প্রকৃত পাণ্ডিত্য লাভের আকাঙ্ক্ষ অপেক্ষ কেবল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইবার আগ্রহ আজ অনেক বেশী দেখিতে পাওয়া যায় । অথচ অনতিপ্রাচীন কালেও এই দেশে জনসাধারণের মধ্যে পণ্ডিতের যেরূপ সম্মান ছিল তাহা ভাবিলেও বিস্থিত হইতে হয়—অনেক সময় সেই সম্মানের বিবরণ পড়িতে পড়িতে উপকথা বলিয়া সন্দেহ হয়। প্রত্যেক সম্পন্ন গৃহস্থ তখন নান উপায়ে দেশের শিক্ষার উন্নতিকল্পে সাহায্য করিতেন। দ্বারপণ্ডিত ও সভাপণ্ডিত প্রত্যেক ভূস্বামীর পাণ্ডিত্যপ্রিয়তার সাক্ষ্য দিত । পুজাপাৰ্ব্বণ ও বিবাহাদি উৎসব উপলক্ষে পণ্ডিত-বিদায়ের প্রথা এবং এই প্রসঙ্গে সমবেত পণ্ডিতবর্গের মধ্যে শাস্ত্রীয় বিচারের দ্বার। পাণ্ডিতোর উৎকর্যাপকর্ষ নির্ণয় ও বিশিষ্ট পণ্ডিতের বিশিষ্ট সম্মান প্রদর্শনের রীতি পণ্ডিতগণকে উংসাহিত করিত—দেশমধ্যে পাণ্ডিত্যের উৎকর্ষসাধনের সহায়তা করিত। অনেক সমর্থ গৃহস্থ পণ্ডিতদিগের বার্ষিক বৃত্তি ব্যবস্থা করিয়া বা নিজব্যয়ে চতুষ্পাঠী পরিচালনের বন্দোবস্ত করিয়া দেশে পাণ্ডিত্যের ধারা অক্ষুণ্ণ রাখিতেন। বৈষয়িক সমাজ এইরূপ কাৰ্যকে অন্যতম অপরিহার্য্য কৰ্ত্তব্য বলিয় মনে করিতেন। ফলে কালোচিত কৃষ্টির প্রবাহ দেশে অব্যাহত থাকিত। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলিতে গেলে— "আমাদের যুদ্ধবিগ্রহ, রাজ্যরক্ষা এবং বিচারকাৰ্য্য রাজ করিয়াছেন, কিন্তু বিদ্যাদান হইতে জলদান পৰ্যন্ত সমস্তই সমাজ এমন সহজভাবে সম্পন্ন করিয়াছে যে, এত নব নব শতাব্দীতে এত নব নব রাজার রাজত্ব আমাদের দেশের উপর দিয়া বস্তার মতো বহিয়া গেল, তৰু আমাদের সমাজ নষ্ট করিয়া আমাদিগকে লক্ষ্মীছাড়া করিয় দেয় নাই। রাজায় রাজার লড়াইয়ের জন্তু নাই—কিন্তু আমাদের মৰ্ম্মরায়মাণু বেণুকুঞ্জে, আমাদের আম-কঁঠালের বনচ্ছায়ায় দেবায়তন উঠিতেছে, অতিথিশালা, স্থাপিত্ত হইতেছে পুপরিণখনন চলিতেছে, গুরমহাশয় শুভঙ্কর কথাইতেছেন, টােলে শাস্ত্র-অধ্যাপনা বন্ধ নাই, চণ্ডী-মণ্ডপে রামায়ণ-পাঠ হইতেছে এবং কীৰ্ত্তনের আরাবে পল্লীর প্রাঙ্গণ মুখরিত।” এ দেশে পণ্ডিতগণের কিরূপ আদর ও সম্মান ছিল প্রাচীন গ্রন্থাদি হইতে তাহারই আংশিক পরিচয় বর্তমান প্রবন্ধে প্রদত্ত হইবে । প্রসিদ্ধ কবি রাজশেখর তাহার কাব্যমীমাংস’ নামক গ্রন্থের ‘রাজচৰ্য্য' প্রকরণে পণ্ডিতবর্গের উৎসাহ ও সাহায্যদান সম্বন্ধে রাজার কৰ্ত্তব্য নিৰ্দ্ধারণ করিয়াছেন । তিনি লিখিয়াছেন--রাজাকে কবিসমাজ বা কবিসভা প্রতিষ্ঠা করিতে হুইবে ; কাব্যপরীক্ষার জন্ত সভা স্থাপন করিতে হইবে । এই জন্ত নিৰ্ম্মিত বিস্তৃত সভাগৃহে কবি, বেদবিং, পৌরাণিক, স্মাওঁ, ভিষকৃ, জ্যোতিষী ও শিল্পী প্রভৃতির জন্ত স্থান নির্দিষ্ট থাকিবে । এই সভার যাহারা সভ্য অর্থাৎ দেশের মধ্যে যাহারা বিদ্বান এবং শিক্ষিত র্তাহাদিগকে ( মধুর উৎসাহপূর্ণ বাক্যে ) তুষ্ট এবং (অর্থাদি সাহায্যদ্বারা) পুষ্ট করিতে হইবে ; উপযুক্ত পাত্রে পারিতোষিক প্রদান করিতে হুইবে ; উৎকৃষ্ট কবি ও তাহার কাব্যের যথোপযুক্ত সম্মান করিতে হইবে । অন্ত দেশ হইতে সমাগত বিজ্ঞানদিগের সহিত রাজা নিজে অথবা কৰ্ম্মচারীদিগের মারফত আলাপ পরিচয় ও ঘনিষ্ঠত করিবেন এবং যতদিন তাহার সেই রাজার শাসিত দেশে অবস্থান করেন ততদিন