৩য় সংখ্যা ] বাটির বুকটা ধড়াস করিয়া উঠিল—কেমন একটা অস্পষ্ট ভয় ও বেদনার স্পন্দন সমস্ত দেহের মধ্যে বিদ্যুৎ গতিতে থেলিয়৷ বেড়াইতে লাগিল। মুহুর্তের মধ্যে বাটি স্তম্ভিত হইয়া গেল, কিন্তু পরক্ষণে সমুদ্রের উপর হইতে বাতাসের একটা ঝটিকা আসিতেই যেন তাহার চমক ভাঙিল; সে তখন ভালো করিয়া দেখিবার জন্ত একাগ্র নয়নে চারি দিকে চাহিল । তাহার চোখে তখন সবই স্পষ্ট দেখা যাইতেছে— ঐ দূরে চক্রবালের দিকে ধুসরবর্ণ বঙ্কিম আকাশ —সমুদ্রের শ্বেত ফেনিল জলোচ্ছ,সি তাহার গায়ে গিয়া আছড়াইয় পড়িতেছে—ভাঙিয়া পড়িয়া দিকে দিকে নানা বর্ণে ফুটিয়া উঠিতেছে ; দক্ষিণে দৈত্যের মতো একটা প্রকাও জাহাজ অসংখ্য চক্ষু বাহির করিয়া স্তব্ধ হইয়া দাড়াষ্টয আছে, দূরে সমুদ্রের ধারে ধারে জেলেদের নৌকাগুলা নানা রঙ্গে হেলিতেছে, দুলিতেছে ; বালির চরের উপর ছেলে মেয়েদের থেলা জমিয়াছে, তাহার কিছু দূরে একটা জনতা— কেহ চলিতেছে, কেহ বসিয়া আছে, কেহ হাসিতেছে, কেহ গাহিতেছে, কাহারো মাথার লাল ফিতা বাতাসে আকাশের গায়ে উড়িতেছে, কাঙ্গারো ওড়না স্থলিত হইয়া পড়িতেছে । বাটির চোখে এসব কিছুষ্ট বাদ পড়িল না—সে সমস্ত জিনিষ খুটিয়া খুটিয়া দেখিতে লাগিল, কিন্তু সকলকার চেয়ে বেশি করিয়া এবং বড় ও স্পষ্ট হইয়া দেখা দিল দুটি মূৰ্ত্তি—একটি পুরুষ ও একটি রমণী ! তাহাদিগকে চিনিতে বাটির বেশি বিলম্ব হইল না— তাহার মাথাটা কেমন ঘুরিয়া গেল, মনে হইল এখনই বুঝি জলের মধ্যে পড়িয়া যায়, সে চতুদিক অন্ধকার দেখিতে লাগিল—এবং সেই অন্ধকারের মধ্য হইতে চোখের সামনে অসংখ্য ফুলিঙ্গ ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। কী উপায়! কী উপায় ! এমন কি কোনো উপায় নাই যাহার দ্বারা ফ্র্যাঙ্ককে এই মুহুর্তে এই স্থান ত্যাগ করানো যায়! ও: পৃথিবীট কী ক্ষুদ্র । যাহাকে এড়াইবার জন্য এত দেশ পালাইয় বেড়ানো হইল, ঘুরিয়া ফিরিয়া তাহারই সচিত সাক্ষাং ! কিছুতেই তাহার দৃষ্টির বাহিরে থাকা গেল না ! এ কী ? এ একটা হঠাৎ ঘটনা ? না এ দৈবপুরুষের চাতুরী ? না—না—এ আর কিছু নয় নিঃসন্দেহ এ নিদারুশ ভাগ্যচক্রের খেল । প্রাচীনকালে শবব্যবচ্ছেদ ©ግ<) তবে বাটি কি করিবে ? দৈবেরই জয় হৌক ! ভয় করিয়া লাভ কি—চেষ্টা করিয়া ফল কি ? যাহা অবশুম্ভাবী তাহাকে কে ঠেকাইতে পারে ? সে তো চেষ্টার ক্রটি করে নাই তবু ভাগ্য ফিরিল কই ? এই ভাবিয়া বাটি হতাশায় নিশ্চল হইয়া বসিয়া রহিল— মনের মধ্যে বাধা দিবার কোনো প্রবৃত্তি, চেষ্টার কোনো উদ্যোগ রঙ্গিল না । সম্মুখে সমুদ্রের চঞ্চল জল খেলা করিতেছে সে তাঙ্কণরষ্ট পানে চাচিয়া যাহা হইবে তাহারই অপেক্ষায় বলিয়া রচিল । স্বার্থের জন্য সংগ্রামের আর আবশ্যক নাক্ট - কি হয় তাহাঙ্গ বসিয়া বসিয়া দেখ। তাছার মনে হইল সমুদ্রের তরঙ্গ যেমন করিয়া কুলে আসিয়া আছড়াইয়া পড়িতেছে তেমনি করিয়া দৈবদুৰ্ব্বিপাক তাঙ্গর উপর আসিয়া পড়িয়াছে, —তরঙ্গের যেমন প্লাবন তেমনি প্লাবনে তাহাকে কোন অতলে ডুবাইয়া দিবে! তাহারা তাহার সমুখ দিয়া চলিয়া গেল। বাটির বুকের এ কী স্পন্দন ! নৈরাশু, ভয়, দুর্ভাবনা তাহার হৃৎপিওটাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলিতেছে । সে কি করিবে ? পালাইবে ? না, না কোনো ফল নাই পালাইয়া! দৈবের হাতে নিস্তাব কোথায় ? তবে ভাগ্যবিধানের জন্য স্থির হইয় অপেক্ষ করাষ্ট শ্রেয় ! কিন্তু আর কত দিন ? হে ভগবান, যাহা অদৃষ্ট্রে লিথিয়াছ তাঙ্গ দাও—শস্ত্র দাও—আর অপেক্ষার যন্ত্রণ সহ চয় না । ( ক্রমশ: ) শ্ৰীমণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়। প্রাচীনকালে শবব্যবচ্ছেদ ( আশুমৃতক পরীক্ষা ) চাণক্যপ্রণীত অর্থশাস্ত্র হইতে সঙ্কলিত । অকস্মাৎ কাহারও মৃত্যু হইলে, তাঙ্গার মৃতদেহ তৈলচচ্চিত করিয়া পরীক্ষা করিতে হইবে। o যে শব শ্লেষ্মা এবং মুত্রদ্বারা কলঙ্কিত, যাহার ইন্দ্রিয়গুলি বায়ুপরিপূর্ণ, হস্তপদ স্ফীত, চক্ষু উল্মীলিত, এবং কণ্ঠদেশে বন্ধনচিহ্ন প্রতীয়মান হয়, সেই ব্যক্তি শ্বাসরোধ হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছে এইরূপ বিবেচনা করিতে হইবে।
পাতা:প্রবাসী (দশম ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২৮৯
অবয়ব