পাতা:প্রবাসী (পঞ্চত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৮৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বর্ষশেষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃথিবীতে আসা-যাওয়া দুইই সত্য, লাভক্ষতি জন্মমৃত্যু স্বখদুঃখ পাশাপাশিই চলেছে। তবু একটা দিনকে আমরা বিশেষভাবে চিহ্নিত ক'রে নিই, মনটাকে রাখতে চাই শেষ হওয়ার দিকে, ক্ষয়ক্ষতি বিচ্ছেদবেদনার দিকে। জন্মমৃত্যু সুখদুঃখ জীবনের প্রতিক্ষণেই আছে—কিছু আসে কিছু যায়। তবু এক সময় আমরা ভয় নিয়ে আসি ভগবানের কাছে, বলি স দূর কর, দুখ দূর কর। প্রিয়বিচ্ছেদে দাও সান, এই যে অন্ধকার, এই যে ক্ষতি এর হাত থেকে বাঁচাও । এই সংসারে মানুষ প্রথম পূজা এনেছে ভয় থেকে। সেদিন মানুষ জানতো না, অমোঘ নিয়ম এই জগতের, এর মধ্যে উদ্ধৃঙ্খলতা নেই। তাই অকস্মাৎ যখন কোন ঝড় এসেছে, আঘাত এসেছে পশু কি মানুষের কাছ থেকে, প্রবল কোন শক্র আক্রমণ করেছে, তখন সে এসেছে প্রবলতর দেবতার কাছে পরিত্রাণ ভিক্ষা করতে। সেদিন খুব ছোট হয়েই সে তার দেবতার কাছে এসেছে তার মনুষ্যত্বকে আত্মনির্ভরকে খৰ্ব্ব করে, বলেছে তুমি বঁচাও আমাকে। কত তার অনুষ্ঠান সেই পূজার, কত জীবহত্য, রক্তে ভাসিয়েছে পৃথিবী—ভেবেছে, যিনি আমাকে মারতে পারেন তাকে খুশী করতে হবে হিংস্রতা দিয়ে, তবেই আমি বঁচিব। আপনার অপঘাত বঁাচাবার জন্য মানুষ কত নির্দোষ পশুকে মেরেছে, মনে করেছে যিনি ভয় দিয়েছেন তার পূজা হবে নিষ্ঠুর রক্তপাতে-নিষ্ঠুর তিনি, তার দয়া নেই। অন্তকেও বেদনা দিয়েছে নিজেও বেদনা পেয়েছে, কত রকমের অদ্ভুত কৃচ্ছসাধন করেছে। ক্রমাগতই সে বলেছে, নিষ্ঠুর আমার দেবতা, নিষ্ঠুরতাতেই তার আনন্দ, তারই উপকরণ যদি জোগাই তবেই আমি সিদ্ধিলাভ করব—এই বলে সে পশুবধ করেছে, মঞ্জস্ব বলি দিয়েছে। এই ভয়বোধ থেকে মাচুর্য হয়েছে নিষ্ঠুর, হিংস্ৰ । - এই ভয়কেই যদি আজকের দিনে আমরা সামনে নিয়ে আসি তবে আমরা কলুষ নিয়ে দুৰ্ব্বলতা নিয়ে আসব, তার প্রতি অবিশ্বাস নিয়ে আসব। সমস্ত দুঃখ মেনে নিয়ে আমরা আজ বলব, আমি যে অমৃতের আস্বাদ পেয়েছি, সমস্ত দুঃখ বেদনাকে আমরা জয় করব। এমন কিছু আমার মধ্যে আছে যা মৃত্যুঞ্জয়, এমন আরোগ্যতত্ত্ব এমন অমৃত আছে যা সমস্ত দুঃথকেই আত্মসাৎ করতে পারে। সেই শক্তির জন্তই আজ আমাদের প্রার্থনা, দুঃখকে বীৰ্য্য দিয়ে জয় করব এই কথাটাই যেন আজ আমরা বলতে পারি। বর্বশেষের প্রার্থনায় আজ এমন কথা বলব না যে সেই দুঃখের ধারাকে নিবৃত্ত কর, বল্ব আমাকে সেই বীৰ্য্য দাও যাতে সকল দুঃখের উদ্ধে উঠতে পারি। আত্মাকে তো মৃত্যু আঘাত করে না, কোনো ক্ষয়ক্ষতি স্পর্শ করে না । আমার পরাভব নেই, তুমি আমাকে মানুষ করেছ—এই বলে মানুষ পরম গৌরবে আস্থক তার মন্দিরে—র্তারচরণতলে এই প্রমাণ করুক যে, যে-মানুষ স্বষ্টি করে তার পরাজয় নেই, মৃত্যুর পরাভবকে সে স্বীকার করে না। তার হাতের জয়তিলক তিনি মানুষের ললাটে পরিয়েছেন। সেই গৌরবে কত দুঃখ কত ক্ষতি কত মৃত্যু তাকে সইতে হয়েছে তবু নিৰ্ভয়ে সে চলেছে তার অভিসারে, আপনাকে পেয়ে জয়ী হয়েছে। ভয় পেয়েছে তো পশু-মামুষ তো ভয় পায় না, সে ভগবানকে বলেছে আমরা তোমার অভয় আশ্রয় চেয়েছি তুমি আমাদের ভয় দূর ক’রে দেবে ব'লে নয়, আমরা ভয় জয় করব ব'লে। অন্ধকারে ভয় আপনাকে বাড়িয়ে দেখে । আমাদের মধ্যে যে ছোট-আমি আছে তারই ছায়ায় আমরা শঙ্কিত হয়ে উঠি । রাত্রির অন্ধকারে পশু ভয় পায় ন!—কিন্তু গ্রহণের অন্ধকারে কাকপক্ষী আশঙ্কায় ভয়ে স্তন্ধ—কারণ এর মধ্যে সামঞ্জস্য নেই, এটা আকস্মিক । দিনের সঙ্গে রাত্রি সামঞ্জস্তসূত্রে গাথা, তাই রাত্রির আবির্ভাবে ভয় নেই। মানুষেরও ষে-মোহ তার মধ্যেই তার ভয়—সেই ভয় দূর করতে হ’লে ছোট আমি-কে সরিয়ে দিতে হয়। সমস্ত বিশ্বের মধ্যে