পাতা:প্রবাসী (পঞ্চত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৯৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্রবাসী বাঙালীর ভাষা-সমস্যা ঐনন্দলাল চট্টোপাধ্যায়, এম-এ, পিএইচ-ডি ভারতবর্ষের “বাবু ইংরেজী” যেমন খাটি ইংরেজদের কৌতুক ও রহস্তের খোরাক জুগিয়ে থাকে, প্রবাসী বাঙালীর ভাষা বা উচ্চারণও কলিকাতাবাসী বাঙালীর নিকট অনেকটা তেমনই আমোদজনক বলে গণ্য। ছটি ক্ষেত্রেই মূল কারণ একই। অর্থাৎ অশুদ্ধ ভাষা ও উচ্চারণ শ্রবণে কৌতুক বোধ করা, বা তাই নিয়ে রংতামাশা করা স্বাভাবিক। “বাৰু ইংরেজী” সম্বন্ধে অনেকে সাফাই দিয়ে থাকেন যে ইংরেজী আমাদের মাতৃভাষা নয়, অতএব বিদেশী ভাষা শুদ্ধ ভাবে লিখতে, বা বলতে না পারলে লজ্জিত হবার কিছু নেই ; বরং আমরা যে পরের ভাষা কষ্ট করে শিখে থাকি সেইটাই আমাদের কৃতিত্বের পরিচয় । অবশু, প্রবাসী বাঙালীর সম্বন্ধে সেরূপ কোন ওজর চলে না, কারণ নিজের মাতৃভাষা ঠিকমত ন-জানা কোন কালেই মার্জনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হতে পারে না। প্রবাসী বাঙ্গালীর ভাষা-সমস্ত শুধু ব্যঙ্গ-বিক্রপেই সমাধান হবে না--ত বলাই বাহুল্য । সমস্তার গুরুত্ব সম্যক্ প্রণিধান করবার সময় আজ এসেছে, বিশেষতঃ আজকাল যখন হিন্দীকে রাষ্ট্রয় ভাষা করবার কথা উঠেছে, কারণ প্রবাসী বাঙালীর মাতৃভাষা-চর্চার পথে প্রধান অন্তরায় পশ্চিমাঞ্চলে হিন্দী-উর্দু শিক্ষার আবস্তিকতা। প্রবাসী ছেলেমেয়েদের শৈশব হতেই স্থলে হিন্দী-উর্দু, বা অন্ত কোন প্রাদেশিক ভাষা শিখতে হয়, কাজেই বড় হয়ে তারা যদি বাংলার ভাষাগত বৈশিষ্ট্য বা উচ্চারণ-পদ্ধতি ভাল ক'রে আয়ত্ত করতে না পারে তাহলে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না। এইখানে বলা দরকার যে প্রবাসী বাঙালীর ভাষা-সমস্তার দুটি দিক আছে,—প্রথমতঃ, উচ্চারণ-বিকৃতি, ও দ্বিতীয়তঃ, ভাষাসাস্কৰ্য্য। সাধারণতঃ হিন্দী-মেশানো মিশ্রভাষা নিয়েই রস্ক-রহস্ত হয়ে থাকে, কিন্তু উচ্চারণ-বিকৃতি তার চেয়ে গুরুতর ব্যাপার। মোট কথা, বাংলার বৈশিষ্ট্য ও সংস্কৃতিকে প্রবাসী বাঙালীকে যেমন ক’রেই হোক রক্ষা করতে হবে তা না বললেও চলে । _ প্রথমে ধরা যাক ভাষাসাস্কৰ্য্য। প্রবাসজীবনের এক যুগ গেছে ফুখন পাটনা, কাশী, এলাহাবাদের মত কয়েকটি বাঙালীবহুল স্থান ছাড়া অধিকাংশ শহরে বাংলা ভাষা ক্রমে লোপ পাবার মত হয়েছিল। তখন নিজেদের মধ্যেও সকলে হিন্দীতে কথা কইতেন, ও হিন্দী-উর্দু রীতিমত শিক্ষা করতেন। বাংলা চিঠিপত্র লিখতে বা পড়তে হ’লে এদের বিপদে পড়তে হত। কিছু দিন পূৰ্ব্বে প্রবাসী-সম্পাদক শ্রদ্ধাস্পদ প্রযুত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় লঙ্কোর ‘বেঙ্গলীক্লাবে একটি বক্তৃতাপ্রসঙ্গে এই সম্বন্ধে অনেক কথা বলেছিলেন। র্তার একটি গল্প শুনে সকলেই আমোদ অঙ্গভব করেছিলেন, সেটি এখানে•উল্লেখ করা যেতে পারে। কোন এক প্রবাসী বাঙালী ভদ্রলোক নিজে বাংলা লিখতে পড়তে জানতেন না বলে এলাহাবাদ হাইকোটের ভূতপূর্ব জজ vপ্রমদাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের নিকট নিজের স্ত্রীর পত্র পড়িয়ে নিতেন, ও তাকে দিয়েই উত্তর লেখাতেন। রামানন্দ বাবু আরও উল্লেখ করেছিলেন যে এককালে লক্ষ্মেী প্রভৃতি শহরে বাঙালীরা থিয়েটার করার পূর্বে নিজের নিজের ভূমিকা না কি ফারসী অক্ষরে লিখে মুখস্থ করতেন। এরূপ দৃষ্টান্ত শুনে এখন বিস্ব লাগে, কিন্তু এৰ কালে তা মোটেই অসাধারণ ছিল না। জয়পুর অম্বরের কালীবাড়ির বাঙালী পুরোহিতেরা "হামু বাঙালী হায়,” বলে বাঙালীত্ব জাহির করেন তা বোধ হয় অনেকেই স্বকৰ্ণে গুনে এসেছেন। এটি হ’ল মাতৃভাষা সম্পূর্ণরূপে বিশ্বত হওয়ার চুড়ান্ত নিদর্শন, কিন্তু এর কাছাকাছি অবস্থা গত শতাব্দীতে অনেক জায়গায় দেখা যেত । স্বখের বিষয়, এই ধরণের দৃষ্টান্ত এখন বিরল। বাংলা একেবারেই লিখতে পড়তে পারেন না এরূপ বাঙালী