পাতা:প্রবাসী (পঞ্চদশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).pdf/৩০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

¢ა8 তৎসংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। আমরা এক্ষণে সেই স্বদুর অতীতের অবস্থা সম্বন্ধে স্বম্পষ্ট ধারণা করিতে অক্ষম। প্রাচীন ভারতে যে কেবল নানাবিধ শিল্প ও বিজ্ঞানের অনুশীলন হইত, তাহা নহে ; পরস্তু কেহ কেহ ইহাদিগের মধ্যে কোনও একবিষয়ে সম্যক ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়া, তদ্বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বলিয়া পরিগণিত হইতেন । বাংসায়ন, প্রণীত ‘কামসূত্র’ নামক প্রাচীন গ্রস্থে, যে চৌযাট ‘কলা’র নাম লিখিত আছে, তন্মধ্যে 'সুবর্ণ রত্ন-পরীক্ষা’, ‘ধাতুবাদ এবং ‘মণিরাগাকরঞ্জানম ( অর্থাৎ, রত্নসমূহের রং ও তাহাদিগের থনি বিষয়ক জ্ঞান ) এই কয়টি নামের উল্লেখ আছে । বরাহমিহির-প্রণীত ‘বৃহৎ সংহিতা' নামক গ্রন্থে লৌহ ও পারদ হইতে প্রস্তুত বলকারক ঔষধের কথা দেখিতে পাই । ‘মহাভাষ্য-প্রণেতা পতঞ্জলি লৌহ-ধাতুবাদ সম্বন্ধে একখানি গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন। এই কয়টি বিষয় হইতে হিন্দু রসায়ন-শাস্ত্রের প্রাচীনত্ব সপ্রমাণ হয়। ভারতীয় রসায়ন-শাস্ত্রের মূল। ইউরোপীয় জাতিদিগের এবং আরববাসীদিগের মধ্যে ‘পরশপাথর ও অমৃতের অনুসন্ধান হইতে রসায়ন-শাম্বের প্রথম উৎপত্তি। প্যারাসেলসসের সময় ( ১৪৯৩—১৫৪১ খৃষ্টাব্দ) হইতে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ পৰ্য্যন্ত চিকিৎসবিদ্যার সহায়করূপে রসায়নের ক্রমবিকাশ সাধিত হইয়াছিল। ভারতবর্ষে ধৰ্ম্মসংক্রাস্ত ক্রিয়াকলাপ হইতে জ্যামিতি ও জ্যোতিষশাস্ত্রের উদ্ভব । ডাক্তার থব প্রমাণ করিয়াছেন যে পাইথাগোরাসের দুই শত বৎসর পূৰ্ব্বে হিন্দুগণ বৈদিক যজ্ঞের বেদী-নিৰ্ম্মাণ উপলক্ষে জ্যামিতির প্রথম অধ্যায়ের সপ্তচত্বারিংশং প্রতিজ্ঞার সত্য নিৰ্দ্ধারণ করিয়াছিলেন । স্রোডারও সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে এই গ্রীক দার্শনিক পাইথাগোরাস ভারতবর্ষের নিকট ঋণী। এই ভারতে যোগের অঙ্গরূপে রসায়নের সম্যক অনুশীলন হইয়াছিল । মামুদ গজনবীর সমসাময়িক অলবেরুণী তাহার ভারতবর্ষ সম্বন্ধীয় পুস্তকের একস্থানে লিথিয়াছেন যে পতঞ্জলির মতে রসায়ন মোক্ষলাভের একটি উপায়। ইহার পর, রসায়ন ক্রমশঃ তন্ত্রশাস্ত্রের সহিত ঘনিষ্ঠ হইতে ঘনিষ্ঠতররূপে সংস্থষ্ট হইয়৷ পড়িল। রসার্ণব নামক তন্ত্রসম্বন্ধীয় একখানি পুরাতন প্রবাসী—ভাদ্র, ১৩২২ [ ১৫শ ভাগ, ১ম খণ্ড গ্রন্থে লিখিত আছে "ষড় দর্শনের মতে দেহের মৃত্যুর পর মোক্ষপ্রাপ্তি ঘটে। কিন্তু এরূপ মোক্ষ করতলন্যস্ত আমলকবং অনুভূত হয় না। সুতরাং পারদ ও ঔষধাদি দ্বারা দেহ রক্ষা করা কৰ্ত্তবা " "রসহৃদয়’ নামক আর-একখানি প্রাচীন তন্ত্রগ্রন্থেও পারদ হইতে প্রস্তুত ঔষধসমূহের গুণের ভূরি ভূরি প্রশংসা দৃষ্ট হয়। “যাহার হর (পারদ ) ও গৌরীর (অভ্র) ক্ষমতায় নিজ নিজ দেহত্যাগ না করিয়া নূতন নূতন শরীর লাভ করিয়াছেন, তাহারা রসসিদ্ধ পুরুষ। সকল মন্ত্রই তাহাদিগের করায়ত্ত ।” যে যোগী জীবিতাবস্থায় মোক্ষলাভ করিতে ইচ্ছা করেন, তিনি প্রথমে নিজের দেহকে উন্নত করিতে চেষ্টা কfরবেন । হর হইতে পারদ এবং গৌরী হইতে অভ্র উৎপন্ন । এই নিমিত্ত, হর ও পারদ একাৰ্থবোধক ; এবং গৌরী ও অভ্রও সেইরূপ। এ সম্বন্ধে একটি শ্লোকের অর্থ এইরূপ —‘অভ্র তোমার বীজ এবং পারদ আমার বীজ। এই দুইটির মিশ্রণে যে পদার্থের স্বষ্টি হয়, তাহ মৃত্যু ও দারিদ্র্য ধ্বংস করিতে সমর্থ। এইরূপে, রসায়ন একশ্রেণীর তন্ত্রের অঙ্গীভূত হইয়৷ পড়িল। প্রাচীন হিন্দুগণের রসায়নজ্ঞান সম্বন্ধে যাহার কোনও ধারণা লাভ করিতে চাহেন, রসার্ণব, রসহদয়, নাগাৰ্জ্জুন-প্রণীত রসরত্নাকর, এবং রসসারে বর্ণিত রাসায়নিক প্রক্রিয়া-সমূহ যথাযথরুপে পরীক্ষা করা র্তাহাদিগের একান্ত কৰ্ত্তব্য কৰ্ম্ম । এই শ্রেণীর তন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা এতই অধিক অনুভূত হইয়াছিল, যে, পারদ সম্বন্ধে একটি নূতন দর্শনশাস্ত্রের স্বষ্টি হইয়াছিল। মাধবাচার্য্য-প্রণীত সৰ্ব্বদর্শনসংগ্রহে এই দর্শন অতি উচ্চ স্থান অধিকার করিয়াছে। এই আদর্শ প্রামাণ্য গ্রন্থ হইতে আমরা এতদ্বিষয়ক একটি মত উদ্ধত করিলাম—‘ন চ রসশাস্ত্রং ধাতুবাদার্থমেতি মন্তব্যং মুক্তেরেব পরম প্রয়োজন ত্বাং' অর্থাৎ ‘রসশাস্ত্র বলিতে কেবল যে রসায়নের একটি শাখা বুঝিতে হইবে তাহা নহে ; পরস্তু পারদ হইতে প্রস্তুত ঔষধ সেবনে শরীরকে অমর করিয়া মুক্তিলাভের বিষয়ও রসশাস্ত্রের অঙ্গীভূত।" এস্থলে রসায়ন’ শব্দের অর্থ সম্বন্ধে দুই একটি কথা নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। সাধারণতঃ 'রস' শব্দের অর্থ পারদ । কিন্তু ইহা দ্বারা ধাতব ও খনিজ পদার্থসমূহওঁ ৫ম সংখ্যা ] বুঝায়। চরক ও স্বশ্ৰুত গ্রন্থে ইহার অর্থ শোণিতাদির উৎপাদক শরীরস্থ রস। সুশ্রীতে রসক্রিয় শব্দের অর্থ ঘন কাথ । ইহার পর, তান্ত্রিক যুগে যখন কেবল উদ্ভজ্জ ঔষধের পরিবর্ক্সে, পারদ ও অন্যান্য ধাতু হইতে প্রস্তুত ঔষধের প্রচলন আরম্ভ হইল, তখন শরীরস্থ রসের উপর পারদের আশ্চর্য শক্তি দেখিয়া, পারদের নাম 'রস' রাখা হইল। প্রাচীন গ্রন্থ-সকলে রসায়ন’ শব্দের অর্থ বাৰ্দ্ধক্যনিবারক ও আয়ূর্বদ্ধক ঔষধ-বিশেষ। ক্রমশ: কেবলমাত্র পারদ ও অন্যান্য ধাতু হইতে প্রস্তুত আয়ুবৰ্দ্ধক ঔষধকেই রসায়ন বলা হইত। রুদ্রযামল-তন্ত্রের অঙ্গীভূত ‘ধাতুক্ৰিয়া নামক পুস্তকে "রসায়নী বিদ্যা এই শব্দটি ইহার বর্তমান ( Chemistry) অর্থে ব্যবহৃত হইতে দেখিতে পাই। পারদ হইতে নানাবিধ ঔষধ প্রস্তুত করিতে যে-সমস্ত রাসায়নিক প্রক্রিয়া আবশ্বক, তাহাদিগের ক্রমবিকাশই হিন্দু রসায়নের ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়। কোনও চিকিৎসা গ্রন্থে কিংব। রাসায়নিক তন্ত্রে কিরূপভাবে পারদের ব্যবহারের বিষয় উল্লিখিত হইয়াছে তাহ দেখিয়া ঐ পুস্তক কোন সময়ে লিখিত, তাহ নিৰ্দ্ধারণ করা যায়। নর্শত খৃষ্টাব্দে বৃন্দ কর্তৃক প্রণীত সিদ্ধযোগ’ নামক পুস্তকে সৰ্ব্বপ্রথম চিকিৎসার্থ পারদ বা বহারের উপদেশ প্রদত্ত হইয়াছে। উক্ত গ্রন্থে পারদ হইতে কজলী প্রস্তুত করিয়া ঔষধরূপে ব্যবহারের বিধি লিপিত আছে। একাদশ শত খৃষ্টাব্দে চক্রপাণি দত্ত এই কজলী'র বিষয় লিথিয়াছেন । তিনি বৃন্দের নিকট তাহার ঋণ স্বীকার করিয়াছেন। ইউরোপীয় রসায়নের ইতিহাসে দেখিতে পাই, যে, সপ্তদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ( চক্রপাণির ছয় শত বৎসর পরে) তুর্কে দ্য মেয়ার্ণ (Turquet de Mayerne) nẽ f**TI< #** ** আবিষ্কার করেন। তিনি ইহার নাম রাখিয়াছিলেন ইথিয়োপীয় খনিজ'। ষোড়শ শতাব্দীতে পারাসেলসস ইউরোপে সৰ্ব্বপ্রথম পারদ হইতে প্রস্তুত ঔষধের প্রচলন আরম্ভ করেন। প্যারিসের ঔষধসভা পারদঘটিত ঔষধ সেবন করিতে নিষেধ করেন । রাসায়নিক তন্ত্রগুলির সংখ্যা এত অধিক, যে, তৎসমুদ্বয়ের উল্লেখ করিলে প্রবন্ধের কলেবর অস্ত্যন্ত দীর্ঘ হইবে, এবং তাহাতে পাঠকগণের ধৈর্য্যচ্যুতির সম্ভাবনা । হিন্দু রসায়ন-শাস্ত্রের প্রাচীনত্ব আমরা এস্থলে, কেবল রসার্ণব নামক একখানি তন্ত্রে বিবর কিছু বলিব। এই গ্রন্থখানি রসায়নীবিদ্যার আধার। ইহাতে তিৰ্য্যকৃপাতন, উৰ্দ্ধপাতন, দহন, প্রভৃতি প্রক্রিয়ার জন্য যে-সমস্ত চুল্পী ও যন্ত্রাদির প্রয়োজন তৎসমৃদয়ের अठनবিষয়ে বিশদ বর্ণনা আছে। অধিকন্তু, ইহাতে তীক্ষ পৰ্য্যবেক্ষণ-শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। কোনও ধাতুকে আগুনে ধরিলে যে রং দেখা যায়, তাহা হইতে ঐ ধাতুটির স্বরূপ নির্ণয়ের উপায় ইহাতে বিবৃত আছে। ‘নেচার’ (Nature) at No. ইউরোপীয় বৈজ্ঞানিক পত্র মৎপ্রণীত হিন্দুরসায়নের ইতিহাস গ্রন্থের সমালোচনার কালে, এই বিষয়ে সমধিক মনোযোগ আকর্ষণ করিয়াছে। আমরা এইখানে একটি শ্লোকের অম্বুবাদ দিতেছি –আগুনে ধরিলে তাম্র নীল রংএর আলো দেয়, টিন পারাবতের দেহের রংএর ন্যায় আলো দেয়, সীসক ফ্যাকাসে রংএর - অালো দেয় । zzy azt -træffirą (Roscoe and Schorlemmer) এসম্বন্ধে লিপিয়াছেন— "Lead compound imparts a pale tint to the non-luminous gas flame." - কোনও ধাতু হন্তে ধারণ করিলে, তজ্জন্ত হন্তে ষে বিশেষ গন্ধ হয়, তাহা হইতে ঐ ধাতুটি কি তাহ জানা যায়। আধুনিক রসায়নগ্রন্থসমূহে এ বিষয়ে প্রায়ই কিছু লেখে না। ১৮৯৮ খ্ৰীষ্টাব্দে ব্রিটিশ এসোসিয়েসনের সভায় অধ্যাপক আয়াটন ধাতু-সকলের গন্ধ বিষয়ে যে বক্তৃতা দেন, তাহাতে তিনি এই বিষয়টির প্রতি শ্রোতৃবৃন্দের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন—একখণ্ড স্বপরিষ্কৃত তাম্র কিছুক্ষণ হস্তের মধ্যে রাখিলে, হস্তে তাম্রের গন্ধ পাওয়া যায়। এই উপায়ে, স্বর্ণ ও রৌপ্য ব্যতীত যাবতীয় ধাতু হইতে ভিন্ন ভিন্ন রূপ গন্ধ বাহির হয়। এই স্থলে, রস-রত্ন-সমুচ্চয় হইতে সীসক সম্বন্ধীয় একটি শ্লোকের অনুবাদ প্রদত্ত হইল—সীসক সহজেই গলিয়া যায় ; ইহা অত্যন্ত ভারী ; ইহা ভাঙ্গিলে উজ্জল কৃষ্ণ বর্ণ দেখায় এবং ইহা পূতিগন্ধ । - এই-সকল পুরাতন পুস্তকে পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বিশেষরূপে বর্ণিত হইয়াছে। ‘রসেজ-চিন্তা