পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/১১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কাৰ্ত্তিক মুহূৰ্ত্ত দেরী করলেও আপনাকেই ফিরিয়ে আনতে পারা যেত না । তা ছাড়া, তাকে ত ফেলে যাচ্ছি না । তিনি আমার সঙ্গেই আছেন এ অনুভূতি যদি আমার স্পষ্ট না থাকত ত হ’লে কি তাকে ফেলে চলে আসতে পারতুম ? তিনিই আমাকে এখনও চালাচ্ছেন। একথা মুখের নয়। র্তার দেওয়া কাজের ভার কাধে নিয়েই ওখান থেকে বেরিয়ে এসেছি । নইলে আসবার দরকার ছিল না।” নিখিলনাথ স্তম্ভিত হ’য়ে গেল এই মেয়েটির এই নিষ্কম্প দৃঢ়তা দেখে। এই মেয়েটিকেই কেমন করে মৃত্যুসংবাদ জানাবে এই ভেবে আবার সে মনে মনে সঙ্কুচিত হচ্ছিল । সীমার বাইরের আচরণ লক্ষ্য করে নিখিলনাথের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় যে তার অন্তরে কি স্রোত বইছে । যেদেহটাকে পুনৰ্জ্জীবন দান করবার জন্যে এই কয় মাস ধরে সে অসাধ্য সাধন করেছে অনায়াসে তাকে সত্যিই জীর্ণবাসের মত পরিত্যাগ ক’রে সে চলে এল কেমন করে । মনে পড়ল সে-যুগে তারাও প্রাণপণে গীতার শ্লোক মুখস্থ করেছে “বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়", কিন্তু এমন ক’রে কেউ যে জীবনের সত্যে তাকে পরিণত করতে পারে তা তার কাছে সম্পূর্ণ অভিনব বোধ হতে লাগল। সত্যদার আদেশ যদি প্রতিপালন করতে হয় তবে এই মেয়েটকে তাদের জতুগৃহ থেকে রক্ষা করতে হবে তাকেই। কিন্তু এ যে কি কঠিন ব্যাপার তা সে মৰ্ম্মে মৰ্ম্মে অনুভব করতে লাগল। তবু তার এই চিন্তাধারার অন্তরালে, সমস্ত সম্পদ বিপদের দুঃসহ সমস্যার সমাধানের অবকাশে এই জনশূন্ত প্রাস্তর, এই নক্ষত্রখচিত অন্ধকার এবং অনন্ত আকাশের বৃহৎ ব্যাপ্তির মধ্যে এই যে ছোট একটুখানি সান্নিধ্য, সমস্ত জনতাপূর্ণ কোলাহলময় জগং থেকে নিঃসঙ্গ নিবিড় এই যে দু-জনের নির্ভরপূর্ণ আত্মসমর্পণ, তার মাধুৰ্য্যটুকু তাকে আবিষ্ট করে তুললে। অল্প একটু স্পর্শ, সামান্ত একটু নিবেদনের তৃষ্ণায় তার চিত্ত ব্যাকুল হয়ে উঠতে চাইল ; কিন্তু কোন প্রকার প্ৰগলভ আচরণের আঘাতে ঐ সমাহিতচিত্ত নারীকে সে তার গভীর মনোলোকের সমাধি থেকে তার নিজের চঞ্চল ভাবলোকের মধ্যে উত্তীর্ণ করার চেষ্টাকে এক প্রকার চপলত ক’রেই যেন নিজেকে সংযত ক’রে রাখলে । অনেক ক্ষণ চলার পর একটা পাকা রাস্তায় উঠে সীমা কথা কইলে। তার কণ্ঠ রসলেশহীন। বললে "এ-কথা নিশ্চয় আপনাকে বলার দরকার নেই যে অাজকের ঘটনাকে আপনার জীবনের পাতা থেকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলে দিতে হবে ; নইলে আপনার বা আমার কারুরই মঙ্গলের সম্ভাবনা নেই। এ-পথ আপনার অপরিচিত নয়, সুতরাং আপনাকে বেশী বলা বাহুল্য মাত্র। আবার ত্রিশ্ৰেণী So\s) যদি কখনও আপনার শরণাপন্ন হতে হয়, আশা করি সেদিন আজকেরই মত আপনার সাহায্য থেকে বঞ্চিত হব না।” তার পর অল্প একটু থেমে বললে, “আর আমার কিছু বলবার নেই। আপনি এই রাস্ত ধরে সোজা মাইল দুই গেলেই ষ্টেশন পাবেন । নমস্কার।" নিখিলনাথ এতক্ষণ নিজের স্বপ্নে বিভোর ছিল । সীমার কথার ভঙ্গীতে অকস্মাৎ যেন একটা কষাঘাতে সম্পূর্ণ জাগ্রত হ’ল। ব্যাকুল হয়ে বললে, “তুমি, তুমি যাবে না ? তুমি কোথায় যাবে ? একলা, এই রাত্রে তোমায় ছেড়ে দিতে পারব না। তুমিও চল ।” এই বৃহৎ বালকটির ধৃষ্টতায় অবাক হয়েই যেন কয়েক মুহূৰ্ত্ত নিখিলের উপর তার উজ্জল চোখ দুটি রেখে সীমা বললে “নষ্ট করবার বেশী সময় এখন আমার নেই । আমি এখন কোথায় যাব সে-খবর দেবার অধিকারও আমার নেই। অার বৃথা সময় নষ্ট করে অযথা নিজের বিপদ বাড়াবেল না।” নিখিলনাথ নিজের দুৰ্ব্বলতা অনুভব ক’রে নিজের প্রতি বিরক্ত হ’য়ে প্রাণপণ বলে নিজেকে আত্মস্থ ক’রে নিলে এবং চেষ্টারুত সহজ দৃঢ় কণ্ঠে বলতে লাগল “সত্যবানের আজ্ঞা প্রতিপালনের ভার আমারও উপর কিছু আছে । মৃত্যুশয্যায় তিনি সনিৰ্ব্বন্ধে যে-ভার আমার উপর দিয়ে গেছেন আমরণ আমাকে তা বহন করবার চেষ্টা করতে হবে। তোমাকেও আমি আকুরোধ করছি যে বারম্বার বিপদের ভয় দেখিয়ে অযথা আমাকে আমার কৰ্ত্তব্যচ্যুত করবার চেষ্টা ক’রে কোন ফল নেই। সত্যবানের আজ্ঞাতেই তোমার খবর রাখবার অধিকার আমার আছে।” সীমা হেসে বললে “সত্যবান কি আপনাকে আমার উপর স্পাই নিযুক্ত করে গেছেন নাকি ?” “না, স্পাই তোমার পিছনে যাতে আর না লাগে তার চেষ্টা করবার ভার দিয়ে গেছেন।” “অর্থাৎ t" “অর্থাৎ, এ-পথের থেকে তোমাকে নিরস্ত করবার ভার আমাকে দিয়ে গেছেন।” সীমার মুখে একটা বিরক্তি ও প্রায়-অবজ্ঞার হাসি ফুটে উঠল, বললে “আচ্ছা, চেষ্টা করে দেখবেন । কিন্তু আজ আমার সময় নেই ডাক্তারবাবু। পরে সময়মত আমার ঠিকানা জানাব না-হয়, আপনার নীতিবিদ্যালয়ের পুথিপত্র নিয়ে যাবেন তখন । কি বলেন ? এর পর দেরী করলে আর গাড়ী ধরতে পারবেন না কিন্তু ! নমস্কার ” বলে আর উত্তরের জন্য অপেক্ষা মাত্র না ক’রে পণচ রাস্ত বেয়ে সে ফিরে গেল । এই মুষ্টিমেয় বালিকাটির অবিচলিত দৃঢ়তায় এক প্রকার