পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/১২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কীৰ্ত্তিক পারব না। এর থেকে তোমাকে আমি ছুটি দিতে চাই পাৰ্ব্বতী।” স্নান হাসিতে পাৰ্ব্বতীর মুখটা বিকৃত হয়ে এল। কষ্টে নিজেকে সম্বরণ করে নিয়ে ব্যথিত কণ্ঠে বললে “ছুটি দিলেই কি ছুটি পাওয়া যায়? ছুটি নিলে আমি থাকব কি নিয়ে বলুন ত?” কথাটা বলেই সে নিজের প্রগলভতায় নিজেই লজ্জিত হ’য়ে উঠল এবং সেটা চাপা দেবার জন্য হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে বললে “কিন্তু তত্ত্বালোচনা করেই কি আজকের রাতটা আমাদের কাটবে নাকি ? উঠুন, যা হয় দুটাে মুখে দিয়ে নিন। নইলে অনেক রাত ক’রে খেলে আবার আপনার হজম হবে না ।” ব’লে সে দ্রুতপদে ঘরের ভিতরে চলে গেল । শচীন্দ্র সেখানে ইজি-চেয়ারে চুপ করে পড়ে ভাবতে লাগল। পাৰ্ব্বতীর কথাগুলোর মধ্যে তার ব্যর্থ জীবনের যে গভীর নিরাশাপূর্ণ বেদনার স্বর বেজে উঠেছিল তার মধ্যে শচীন্দ্রের প্রতি কি একটা অভিমানের আভাস ছিল না ? শচীন্দ্রের মনটা নিজের সঙ্গে যেন কোন মতে বোঝাপড় ক’রে উঠতে পারছিল না। আবার তার মনের মধ্যে এই দুর্ভেদ্য সমস্ত অন্য রূপ নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগল। তার মন কি সত্যই এখনও কমলের মৃত্যুঞ্জয়ী স্থতিকে আশ্রয় করে চলেছে তার অনন্ত যাত্রায় ? যেখানে একদিন সে পরিপূর্ণতার মধ্যে ফিরে পাবে তাকে ? না, এ শুধু পত্নীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করায় অভ্যস্ত তার মন কিছুতেই তার এত দিনের অভ্যাসকে অস্বীকার করতে পারছে না? উদভ্ৰাস্ত শিবের মত কমলার স্থতিককাল বহন করে বেড়ানোর লৌকিক মূল্যের ভিক্ষাপাত্র এবং আত্মবিমোহনের নাগপাশ কি তার সমস্ত সত্যকে সমগ্র অন্তরাত্মাকে আবিষ্ট করে ফেলেছে এত দিন ধরে ? সে তার অন্তরের ধ্যানলোকে তার নিরুদিষ্ট পত্নীর মুখ ফুটিয়ে তোলবার চেষ্টা করতে লাগল ; কিন্তু সেই বিরাট তারা-খচিত স্নান অন্ধকারের পটে কোথাও তাকে যেন সে খুজে পেল না। সে বিশেষ করে ত্রিবেণীর গঙ্গাতীরের সেই শেষ দৃশ্বের মাঝখানে তার হারানো স্ত্রীর কৌতুহলোদীপ্ত ছবিখানি মনের মধ্যে আঁকতে চেষ্টা করতে লাগল ; কিন্তু সেই বিপুল চলচঞ্চল শোভাযাত্রার ভিড়ে সে যেন এলোমেলো হয়ে মিলিয়ে গেল। সে তার মনের দৃষ্টিকে স্বদুর অতীতের মধ্যে প্রসারিত করে দিয়ে পড়ে রইল। কিন্তু তার পত্নীর প্রতিকৃতি তার চিত্তপটে জাগিয়ে তোলবার চেষ্টার মধ্যে সে-মুখ হারিয়ে হারিয়ে গেল। এমনি ক'রে বহুক্ষণ ব্যর্থ চেষ্টায় হতাশ হয়ে এই ব্যর্থতাকে কমলার স্মৃতি থেকে বিচ্ছিন্নতা বলে কল্পনা করে তার উত্তেজিত মস্তিষ্কের চিন্তাম্রোতকে ফিরিয়ে ভবিষ্যতের গৃহ রচনায় প্রবৃত্ত করলে এবং সেই গৃহে পাৰ্ব্বতী সহজ আনন্দে দীপ্তিময়ী কল্যাণীরূপে ক্রিবেণী SQN. বিরাজ করছে, এমনি একটা মুখচ্ছবিকে সে মনের মধ্যে গ্রহণ করতে চেষ্টা করতে লাগল। অনেক ক্ষণ চুপ করে এই চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে থেকে এক সময় অকস্মাৎ সচেতন হয়ে দেখলে যে বহু চেষ্টাতেও এতক্ষণ যার ছবি সে ফোটাতে পারে নি সেই অৰ্দ্ধবিশ্বত নারী কথন তার সমস্ত কাল্পনিক ভবিষ্যৎকে মুছে ফেলে দিয়ে স্থপরিচিত বাস্তব গৃহচিত্রের মধ্যে স্বম্পষ্ট হয়ে উঠেছে । সে আর চুপ ক’রে বসে থাকতে না পেরে বারান্দায় উঠে পায়চারি করতে লাগল। একবার মনে করলে পাৰ্ব্বতীর কাছে ষায়, গিয়ে বলে “পাৰ্ব্বতী, এমনি করে তুমি নিজেকে আবদ্ধ রেখে আমাকে বেঁধে না। তোমার উপযুক্ত মূল্য দিতে আমি অক্ষম । আমার এই দুগ্রহ নিয়ে আমাকে একলা দুর্গ ভোগ করতে দাও।” কিন্তু সে কিছুতেই মন স্থির করে উঠতে পারলে না। তার পায়ের শব্দ পেয়ে পাৰ্ব্বতী এসে নিঃশব্দে অন্ধকারে দরজা ধরে চুপ করে ভাবতে লাগল। শচীন্দ্রের এই অস্থিরতার কারণ সে যেন ঠিক বুঝে উঠতে ভরস পায় না। তার নারীসুলভ সহজ অনুভূতি দিয়ে যে সন্দেহ তার অস্তরে জেগে ওঠে তাকে তার আনন্দভরা দুরাশার মধ্যে কিছুতেই আমল দিতে চায় না। আশাআশঙ্কা-আকাঙ্ক্ষার উত্তেজনায় তার হৃদয়ের মধ্যে রক্তস্রোত উত্তাল হ’য়ে উঠল। সে তাড়াতাড়ি ফিরে গিয়ে নিজের নিভৃত শয়ন কক্ষে বিছানার উপর বালিশটাকে বুকে প্রাণপণ বলে চেপে ধরে উপুড় হয়ে পড়ে রইল । অনেক ক্ষণ পরে সে বারান্দায় ফিরে এল ; দেখলে, শচীন্দ্র বারান্দার একটা থাম ধরে স্থির হয়ে পরপারে কৃষক-কুটীরের সেই অচঞ্চল রশ্মিরেখার দিকে নির্নিমেষে চেয়ে দাড়িয়ে আছে। পাৰ্ব্বতী ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে এল এবং কিছু না বলে চুপ ক’রে তার পাশে এসে দাড়াল । তার মনের স্বগভীর অন্তরালে অশ্রুর যে-উৎস উচ্ছসিত হয়ে উঠতে চাইছিল তাকে অস্তরের মধ্যে প্রাণপণ বলে চেপে ধীরে ধীরে সে অত্যন্ত স্নেহে চিস্তাতাপক্লিষ্ট শচীন্দ্রের একখানি হাত তার হাতে তুলে নিলে। স্নেহাভিব্যক্তির এই কোমল স্পর্শের মধ্যে এই চিরবঞ্চিত নারীর তাকে সাত্বনা দেবার গভীর করুণাটুকু শচীন্দ্রের মনে এসে একটা অনুশোচনার মত আঘাত করলে এবং নিজের দুৰ্ব্বলতায় সে মনে মনে লজ্জা অঙ্গভব করতে লাগল। পুরুষের যে আত্মসমাহিত দৃঢ়তা যে আত্মপ্রত্যয় নারীর নিকটে তাকে নির্ভরযোগ্য আশ্রয়, তার সহজ আত্মদানের প্রতিষ্ঠাভূমি করে, নিজের মধ্যে সেই অবিচলিত পৌরুষের দৈন্ত অঙ্গভব করে মনে মনে সে নিজেকে তিরস্কার করলে “না, এমনি ক’রে পাৰ্ব্বতীর নিরাশ্রয় মনের উপর তার নিজের পীড়িত চিত্তের ভার সে চাপতে দেবে না। হয় সে