পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

স্বধা একটুখানি হাসিয়া বলিল, “তাহলে শিবুর সঙ্গেই আপনার নামের মিল বেশী, ও এত বেশী গেলে যে পিসিমা ওকে ভীমসেন বলেন ।” শিবু বলিল, “ সে বাপু, আমি খাবই। আমি বিধবা হলে মোটেই পিসিমার মত একাদশী করব না।” স্বধীন্দ্রবাবু অট্টহাস্য করিয়া বলিলেন, “এইবার শিবুবাবু ঠীকে গেছ, পুরুষ মানুষে কি বিধবা হয় ?” পরাজয়ের লজ্জায় শিবুর স্বন্দর মুখখানা লাল হইয়া উঠিল । মহামায়া বলিলেন, “ও ডেপো ছেলেটাকে আপনি আর আস্কার দেবেন না। আমার ঘর-সংসারের ব্যবস্থা কি করলেন তাই আগে বলুন। আপনার উপরই ত আমার সব ভরসা । আমি ত কুটো ভাঙতেও পারি না, লোক না হলে খেটে খেটে মেয়েটার জিভ বেরিয়ে পড়বে। ” স্বধীন্দ্রবাবু একটু লজ্জিত স্বরে বলিলেন, “লোক ঠিকই তৈরি আছে, আমি খবর দিতে একটু দেরী করে ফেলেছিলাম তাই এখন এসে উঠতে পারল না । ভোর বেলা ঠিক আসবে। আর সন্ধ্যে বেলা আমার বাড়ী থেকে আপনাদের জন্যে যৎসামান্ত কিছু খাবার আসবে। ইতিমধ্যে স্বধার সাহায্য পেলে বাকি কাজগুলো আমি ক’রে দিতে পারি।” স্বধাও যে কাহারও সাহায্যের অপেক্ষ রাখে না তাহা বুঝাইবার জন্য ডুরে কাপড়ের আঁচলটা কোমরে জড়াইয়া বিছানার গাদার উপর দুই হাটু গাড়িয়া বসিয়া দড়ির গিট খুলিতে লাগিল। বিছানার পুলিন্দার ভিতর হইতে বিছানপদবাচ্য নয় এমন বহুৎ জিনিষ বাহির হইয়া পড়িল। ছাতা লাঠি, বীট, তোয়ালে, ধুতি, শাড়ী, যাহা কিছুই সঙ্কীর্ণ আয়তনের আধারে ঠাই পায় নাই, সবই নির্বিচারে শ্ৰীক্ষেত্রের যাত্রীর মত এখানে একাসনে বসিয়া পড়িয়াছে। সেইগুলিকে বাছাই করিয়া স্বধা বিছানাগুলাকে ঝাড়িয়া তক্তাপোষের উপরে তুলিল। চন্দ্রকান্ত বলিলেন, “রন্ধনবিদ্যায় আমার অপটুতা সৰ্ব্বজনবিদিত হলেও জল তোলায় আমার খ্যাতি আছে । তোমাদের শৃঙ্খলিত গঙ্গাদেবীর কারাগৃহটি কোথায় ব’লে দাও, জল আমি সবটাই তুলে আনি । ” শিবু বলিল, “আমি ওকাজ করতে পারি,” বলিয়াই বালতির গর্ত হইতে বাসনকেশন সব মেঝেয় নামাইয়া সে জলপাত্র যোগাড় করিতে লাগিল । একটা শূন্তগর্ত বালতিকে অবলম্বন করিয়া দাড়াইতে গিয়া ছোট খোকা সেটাকে নিজের মাথার উপরই উপুড় করিয়া দিল । মহামায়া সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিয়া বলিলেন, “ ছেলেটাকে একটা খাটের খুরোর সঙ্গে বেঁধে রেখে বাপু, তোমরা কাজকর্ম কর, নইলে গড়িয়ে ও ত সদর রাস্তায় গিয়ে পড়বে।” বালতির ভিতরের অন্ধ কারাগার হইতে খোকন কাদিয়া বলিতে লাগিল, “আমা তুপি খুলে দাও।” স্বধীন্দ্রবাবুর সাহায্যে সেদিনকার মত আহার-নিদ্রার ব্যবস্থা হইয়া গেল। তিনি বিদায় লইবার সময় সংসারচক্রের আবর্জেনে যতখানি সহায়তা তাহার পক্ষে করা সম্ভব সবই করিবেন প্রতিশ্রুতি দিয়া বন্ধু-পরিবারকে আশ্বস্ত করিয়া গেলেন । সকলে ঘুমাইয়া পড়িলে খোলা জানালার ভিতর দিয়৷ অন্ধকার রাত্রির দিকে তাকাইয়া পিসিমার কঠিন কোমল মুখখানির কথাই বার বার স্বধার মনে পড়িতেছিল । মৃগাঙ্ক দাদাকে একলা ভাত বাড়িয়া দিয়া পিসিমা হয়ত আজ জলও না খাইয়া মেঝের উপরই শুইয়া পড়িয়াছেন। হয়ত শূন্তপ্রায় বাড়ীতে বিনিদ্র চক্ষে স্থধারই মত রাত্রির প্রহর শুনিতেছেন । ঘরের আলো নিবিয়া গিয়াছে । অপরিচিত আবেষ্টন অন্ধকার আকাশের অতি ক্ষীণ তারার আলোকে আরও অপরিচিত অনন্ত রহস্যময় মনে হইতেছে। সুধা কি পিসিমার ঘরের মাচার উপর আজ বিছানা করিয়া ঘুমাইয়াছিল, তাহার পর একলা পাইয়া আরব্য উপন্যাসের দৈত্য, চীন রাজকুমারী বেদুরার মত ঘুমন্ত স্বধাকে শয্যা সমেত আকাশপথে উড়াইয় আনিয়াছে ? অৰ্দ্ধ ঘুমে অৰ্দ্ধ জাগরণে সমস্ত পৃথিবীর বিচিত্র পরিবর্তনশীল রূপ দেখিতে দেখিতে স্বধা এ কোথায় আসিয়া পড়িয়াছে পুৰ্ব্ব দিকের আকাশের গায়ে আকাশম্পর্শী একটি স্তম্ভের মুখ হইতে ঘন কুণ্ডলায়িত কালো ধোয় প্রকাও অস্পষ্ট সরীস্বপের মত বাকিয়া বাকিয়া উদ্ধপথে কোথায় গিয়া মিলাইয়া যাইতেছে । এখনই হয়ত আরব্য উপন্যাসের দৈত্যের মতই স্পষ্ট রূপ ধরিয়া স্থধাকে আবার পিসিমার কোলের কাছে লইয়া গিয়া নামাইয়া দিবে, অথবা এ তাহার বিদায়