পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্রবঞ্চনা ঐবিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় - 3. প্রজাপতি-সংহিতার আধুনিকতম সংস্করণে লেখা হইয়াছে— প্রয়োজন বুঝিলে মেয়ে অসাবধান হইয়া হাতের রুমালটি ফেলিয়া দিবে ; ছেলে সেটি সাবধানে তুলিয়া ধরিয়া দাসত্বগৌরবের অভিনয় করিয়া বলিবে—“আপনার রুমালটা--- মেয়ে সেটি গ্রহণ করিয়া বলিবে—“থ্যাঙ্কস", অর্থাৎ ধন্যবাদ। ছেলে প্রবল কুষ্ঠার সহিত বলিবে, “নীড়, নটু মেন্‌গুন", অর্থাৎ উল্লেখ করে লজ্জা দেবেন না। ইহার পর দু-জনে ন-চাহিবার চেষ্টা করিয়া আর একবার সলজ্জ ভাবে চাহিয়া ফেলিবে । অতঃপর সংহিতাকার নিজেই কৰ্ম্মক্ষেত্রে নামিয়া পড়িয়া স্থানকালপাত্র হিসাবে ব্যবস্থা করিবেন। বিমলেন্দু কলিকাতার একটি কলেজে তৃতীয় বাৎসরিক শ্রেণীর ছাত্র। একদিন কলেজের প্রাঙ্গণে ঐ শ্রেণীর নবাগত ছাত্রী অর্জন রায়ের রুমালটি কুড়াইয়া দিবার তাহার একটু স্বযোগ ঘটিয়া গেল। বিমলেন্দু ছেলেটি বুদ্ধিমান, বুঝিল দুৰ্য্যোগের মত স্থযোগও কখনও এক আসে না। সে তর্কেতর্কে রহিল এবং এক সপ্তাহের মধ্যে আরও তিনটি অনুরূপ স্বযোগ দৈব অথবা তাহার পুরুষকারের বলে ঘটা গেল। }চতুর্থ দিবসে শাস্ত্রনিদিষ্ট ধন্যবাদাদির পরও সিড়ি দিয়া উপরে উঠতে উঠতে কিছু অতিরিক্ত আলাপ হইল। বিমল প্রশ্ন করিল—“আপনার কোন ইয়ার ক্লাস ।" জানা জিনিষ লইয়া এরকম অজ্ঞ সাজিতে গেলে মনের কথাটি বড়ই স্পষ্ট হইয় ওঠে। অর্চনা সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিতে পারিল না, একটু লজ্জিত হইয়া মুখটি ঘুরাইয়া লইল। তখন বিমলেন্দুও সামলাইয়া লইবার চেষ্টা করিয়া কহিল— "ও, ঠিক ত! আপনাকে আমাদের থার্ড ইয়ারেই কোন কোন ক্লাসে যেন দু-একবার দেখেছি বলে মনে হচ্ছে** কথাটাকে একটু টানিয়া সত্য রূপ দেওয়া যায়। যত ক্ষণ | ` ক্লাস চলে প্রতিমিনিটে বিমলেন্দু অর্চনাকে দু-একবার দেখে। ব্যাপারটা অৰ্চনার এমন কিছু অবিদিতও নয় ; কিন্তু আশ্চর্ঘ্যের বিষয়, এই মিথ্যার প্রতিবাদ করা ত দূরের কথা, সামান্য অবিশ্বাসের ভাবও দেখাইল না। বিমল দুটা সিড়ি উঠিয়া আবার প্রশ্ন করিল—“আপনার রোল নম্বর ?” অর্চনা উত্তর করিল—“সাতাশী।” সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নও —“আপনার ?” বিমলেন্দুর দুই আঙুলে ধরা নোটবুকটা সিড়িতে পড়িয়া গেল, সেটা কুড়াইয়া লইয়া বলিল—“অষ্টআশী।” অৰ্চনা স্বধু একটু ভ্ৰকুঞ্চিত করিয়া বলিল—“ও ” —তাহার এ অসামান্ত কথাটি যেন মোটে জানাই ছিল না। মিথ্যাকে আমরা প্রবন্ধ-বক্তৃতাতে যতই লাঞ্ছনা করি না কেন, এ-সব ক্ষেত্রে কার্য্য অগ্রসর করিয়াদিতে অমন বস্তু আর নাই। দিব্য একটি নিৰ্ব্বিল্প প্রচ্ছন্নতার আড়াল দিয়া যেন দপণে উভয় উভয়ের মনটি দেখিয়া লইল । তাহার পরদিন বিমলেন্দুর ধৈর্য্য ও অধ্যবসায়ের জন্য আবার দু-জনের হঠাৎ সিড়ির গোড়ায় দেখা হইয়া গেল। বিমল নমস্কার করিয়া বলিল—“আজ দেখছি যে আপনারও বডড লেট হয়ে গেল, আমি ভাবলাম বুঝি আমার একারই দেরী হ’ল।” অর্চনা তাড়াতাড়ি সিড়ি দিয়া উঠিতে উঠিতে হাতঘড়িটার দিকে চাহিয়া বলিল—“হ্যা, দেখুননা ; একটামাড়োয়ারী ম্যারেজ প্রসেগুনের জন্তে গাড়ীটা আটকা পড়ে গেল। প্রায় আাধ ঘট ধরে নিরুপায় ভাবে দাড়িয়ে থাকা—সে যে কি বিড়ম্বনা ---” বিমল বলিল—“সে আর বলতে ? -- আমারও খানিকটা দেরী হয়ে গেল। পনের মিনিট দেরী, প্রফেসার গুপ্ত নিশ্চয় প্রেজেন্ট করবেন না ; যাব কিনা ভাবছি, এমন সময় আপনাকে দেখে কতকটা ভরসা হ’ল।”