পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৪৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পৌৰ নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদণ HNෂNළං তার নৃত্য রেখার লীলায় আবদ্ধ থাকতে পারে না। এখানে দক্ষিণী নৃত্যাভিনয় এবং মণিপুরী নৃত্যের আঙ্গিক আরও বেশী করে গ্রহণ করতে হবে। দক্ষিণী অভিনয় স্থল, কিন্তু তার প্লেন-ভাঙাটা নূতন ও জটিল, চিত্রাঙ্গদা নাটকটির প্রকৃতিরই অনুযায়ী। সমবেত নৃত্যে মণিপুরী, ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে পুরুষ-নৃত্যে দক্ষিণী, এবং মহিলা-নৃত্যে উত্তরভারতীয় আঙ্গিক নৃত্য-নাট্যে তাই গৃহীত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। গৃহীত অর্থে সমন্বিত। সমন্বয়টিই আসল কথা। সমগ্রভাবে দেখলে নিশ্চয়ই স্বীকার করতে হবে এই সমন্বয়কে। যেস্বষ্টিতে এত ভিন্ন ধরণের নৃত্য, সঙ্গীত, চিত্র প্রভৃতি চারুকলার সমাবেশ হয়েছে তাকে স্বষ্টি বলতেই হয়। দেশের মন যদি জাগ্রত ও স্বষ্টিমুখী হয় তবেই তার মহত্ব উপলব্ধি সম্ভব । বিশুদ্ধ নৃত্যের দিক থেকে বলা যায় যে চিত্রাঙ্গদায় নৃত্যকলা মুক্তিলাভ করেছে। যোগশাস্ত্রে বলে কানই নাকি যোগীর পরম শত্রু । অন্ততঃ বিশুদ্ধ নৃত্যকলা উপভোগের বেলা ত বটেই। সঙ্গীত-ভিন্ন নৃত্যের অস্তিত্বে আমরা অভ্যস্ত নই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আমাদের অভ্যাস ভাঙার দুঃসাহসিক কাজেই ব্ৰতী হয়েছেন। চিত্রাঙ্গদা-অভিনয়ের মধ্যে সঙ্গীত শুদ্ধ হয়, মাত্র তাল চলে—স্বত্য তখন পুরুষের। দুটি বার সঙ্গীতের এই রকম বিরাম অনেকেই লক্ষ্য করে থাকবেন। কেন সঙ্গীত স্তন্ধ হয় আমাদের বিচাৰ্য্য। প্রথমত কথা থেকে নিস্কৃতি পেলে সঙ্গীতের অধীনে আসতেই হয়, সঙ্গীত অর্থে বিশুদ্ধ স্বর (রাগিণী নয়)। আমাদের স্বরগুলিতে আরোহী-অবরোহী ভিন্ন অন্ত ভুজ নেই, অর্থাৎ গায়ন-পদ্ধতি একই প্লেনে চলে। ( যন্ত্রবাদনে দুটি ভূজ আছে । ) সেই জন্য নৃত্যে যখন দুইয়ের অধিক প্লেনে দেহকে ভাঙবার প্রয়োজন হয় তখন তার সমর্থন হিন্দুস্থানী গায়ন ও বাদন পদ্ধতিতে পাওয়া শক্ত। নৃত্যনাট্যের জন্ত হয় বিদেশী হার্শনির সাহায্য গ্ৰহণ আর না-হয় চুড়ান্ত মুহূর্ডে সঙ্গীতকে থামান, এই দুটি পথ আমাদের সম্মুখে রয়েছে। আজকালকার থিয়েটার ও সিনেমা সঙ্গীতে প্রথমটি অবলম্বিত ঠিক না হলেও তারই দিকে ঝোক পড়েছে। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু স্বেচ্ছায় “ভূমিকা থেকে ভ্ৰষ্ট হতে চান না। অতএব, দ্বিতীয়ত, সঙ্গীত নীরব হতে বাধ্য। নীরব, কিন্তু তার প্রাণম্পন্দন চলছে। স্পন্দনের ছন্দের মতন তখন আঘাত চলেছে, কিন্তু সে-আঘাতে বাটোয়ারা নেই। জাগরণ ও নিদ্রার সন্ধিক্ষণের স্বযুধিতে শ্বাসপ্রশ্বাস রুদ্ধ নয়, তবে তার ক্রিয় নিতান্তই সরল। নাট্যের জটিলতা এই সরল আঘাতে পরিণত হ’ল। সেই সঙ্গে প্রকাশ পেল নৃত্যকলার শুদ্ধতা অর্জনের অনুচ্চারিত ইঙ্গিত । এতক্ষণ আমি নৃত্যের স্বরাজসাধনের বিবরণ দিলাম। স্বরাজ পাবার পর আন্তর্জাতিক মিলনই প্রকৃত মিলন। তখনই হয় বন্ধুত্ব—কারণ তখন কাউকেই অন্যের অধীনে থাকতে হয় না। শুদ্ধ নৃত্যকলার উদ্ভাবনা অর্থে সঙ্গীতকে পদানত করা নয়। সব জ্ঞানে, সব কলাবিদ্যার উৎকর্ষের ইতিহাসেই ছুটি গতি আছে, ত্যাগের দ্বারা শুদ্ধি, এবং শুদ্ধির পর সমানে সমানে, পরিত্যক্তের সঙ্গে পুনরায় সম্বন্ধ স্থাপন । রবীন্দ্রনাথ শুদ্ধতায় আরোহণ করে সম্বন্ধে অবরোহণ করেছেন—তাই চারুকলার সমন্বয় চিত্রাঙ্গদায় সৰ্ব্বাঙ্গীন হয়েছে। কোন কলার প্রতি অশ্রদ্ধা স্থচিত হয় নি। চিত্রকলার ব্যবহার কত স্বচারু হয়েছে বোঝাতে পারব না। তবে রঙের অর্থাৎ সাজসজ্জার ও দুগুপটের অবস্থান অত্যন্ত স্বসমঞ্জস হয়েছিল অভিজ্ঞ ব্যক্তি মাত্রেই স্বীকার করেছেন । শুনেছি, সেজন্য কবি প্রতিমা দেবী ও স্বরেন্দ্র কর মহাশয়ের কাছে ঋণী। আমি নৃত্যনাট্যে গানের ব্যবহার’ একটু বিচার করব । বলা বাহুল্য, ব্যবহার অর্থে সম্পত্তির ব্যবহার নয়। চিত্রাঙ্গদ নৃত্যনাট্য, ভুললে চলবে না। যেখানে নাট্য সঙ্গীতাধীন সেখানে নাটকীয় গতি রুদ্ধ হয়। আবেগ যায় থেমে যখন শ্রোতৃবৃন্দ নৃত্যরত নায়ক-নায়িকার মুখে গান শোনে। পুরাতন কালে যাত্রায় তাই হ’ত। ক্রতি রক্ষার জন্তু অন্ত এক দল গায়ক-গায়িকাকে রঙ্গমঞ্চে অবতারণ। করবার রীতি আছে। এই রীতিটাও প্রাচীন। কিন্তু বাংল। যাত্রায় তার ফল হ’ত বিপরীত। কথাকলি, বলী, এমন কি আধুনিক উদয়শঙ্করের নৃত্যের ফল কিন্তু শুভ হয়েছে। ‘মায়ার থেলা', কিংবা “বাল্মীকি-প্রতিভায় রীতিটির সাক্ষাৎ পাই না । ইদানীং রবীন্দ্রনাথ আবার সেটি অবলম্বন করেছেন। চিত্রাজদায় তাঁর চরম বিকাশ।