পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৭১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

থাকিয় প্রকৃতির প্রকোপে বৰ্ত্তমান অবস্থায় উপনীত হইয়াছে। ভিতরে বাসোপযোগী ঘর দু-এক খান এখনও খাড়া থাকিতে পারে, কিন্তু বাহির হইতে তাহ অনুমান করিবার উপায় নাই । বাড়ীর সম্মুখে উপস্থিত হইয়া সঙ্গী বলিলেন, "বাইসিকেল এইখানে রাখুন —বলিয়া ভিতরে প্রবেশের উপক্রম করিলেন । আমি আর বিস্ময় চাপিয়া রাখিতে পারিলাম না, বলিলাম, ‘আপনি এই বাড়ীতে থাকেন ?" ‘হ্যা। আমুন।” তাহার কণ্ঠস্বর পরিষ্কার বুঝাইয়া দিল যে অযথা কৌতুহল তিনি পছন্দ করেন না। আর প্রশ্ন করিলাম না, দেয়ালের গায়ে বাইসিকেল হেলাই রাখিয়া তাহার অনুগামী হইলাম। তৰু মনের মধ্যে নানা উত্তেজিত প্রশ্ন উকিঝুকি মারিতে লাগিল। বিহারের এক প্রাস্তে শহর—লোকালয় হইতে বহুদূরে একটি ভাঙা বাড়ীর মধ্যে এই বাঙালী ভদ্রলোকটি কি করিতেছেন ? কে ইনি! এই অজ্ঞাতবাসের অর্থ কি ? নানা প্রকার ভাবিতে ভাবিতে র্তাহার সঙ্গে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। অভ্যস্তরের পথ কিন্তু অতিশয় কুটিল ও বিস্ত্রসস্কুল। সদর দ্বারের অশখগাছ উত্তীর্ণ হইয়া দেখিলাম একটা দেয়াল ধ্বসিয়া পড়িয়া সম্মুখে দুলভঘ্য বাধার স্বষ্টি করিয়াছে ; তাহাকে এড়াইয়া আরও কিছু দুর যাইবার পর দেখা গেল, একটা প্রকাও শালের কড়ি বক্রভাবে প্রাচীর হইতে অবতীর্ণ হইয়া মাঝখানে আগড় হইয়া দাড়াইয়া আছে। পদে পদে কাটাগাছ বস্ত্র আকর্ষণ করিয়া ধরিতে লাগিল ; যেন আমাদের ভিতরে যাইতে দিবার ইচ্ছা কাহারও নাই । যা হোক, অনেক ঘুরিয়া ফিরিয়া অবশেষে এক দরজার সম্মুখে আসিয়া আমার সঙ্গী দাড়াইলেন। দেখিলাম দরজায় তালা লাগানে । তালা খুলিয়া তিনি মরিচ-খর ভারী দরজা উদঘাটিত করিয়া দিলেন, তার পর আমাকে ভিতরে প্রবেশ করিতে ইঙ্গিত করিলেন। অন্ধকার গহবরের মত ঘর দেখিয়া মহল প্রবেশ করিতে ভয় হয়। কিন্তু যে চক্রব্যুহের এতটা পখনিরাপত্তিতে আসিয়াছি, তাহার মুখ হইতে ফিরিব কি বলিয়া ? বুকের ভিতর অজানা আশঙ্কায় দুরু ছুরু করিয়া উঠিল—এই অজ্ঞাতকুলশীল সঙ্গীটি কেমন লোক ? কোথায় আমাকে লইয়া চলিয়াছেন ? কণ্ঠের মধ্যে একটা কঠিন বস্তু গলাধঃকরণ করিয়া চৌকাঠ পার হইলাম । তিনিও ভিতরে আসিমা দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন। টর্চের আলো একবার চারিদিকে ঘুরিয়া নিবিয়া গেল । রুদ্ধশ্বাসে অনুভব করিলাম, তিনি আমার পাশ হইতে সরিয়া গিয়া কি একটা জিনিষ লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছেন। পরক্ষণেই দেশলাইয়ের কাঠি জলিয়া উঠল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল ল্যাম্পের আলোয় ঘর ভরিয়া গেল । এতক্ষণে আমার আবছায়া সঙ্গীকে স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম। মধ্যমাকৃতি লোকটি, রোগ কিংবা মোট কোনটাই বলা চলে না, মুখের গড়নও নিতান্ত সাধারণ,— কেবল চোখের দৃষ্টি অতিশয় গভীর, মনে হয় যেন সেদৃষ্টির নিকট হইতে কিছুই লুকান চলিবে না। চোয়ালের হাড় দৃঢ় ও পরিপুষ্ট, গোফ-দাড়ি কামান—বয়স বোধ হয় চল্লিশের কাছাকাছি । পরিধানে একটা চেক-কাট রেশমের লুঙ্গি ও পাশুটে রঙের মোটা কোট-সোয়েটার। তাহার চেহার ও বেশভূষা দেখিয়া সহসা তাহার জাতি নির্ণয় করা কঠিন হইয়া পড়ে। তাহার গম্ভীর সপ্রশ্ন চোখদুটি আমার মুখের উপর রাখিয়া অধরে একটু হাসির ভঙ্গিমা করিয়া তিনি বলিলেন, ‘স্বাগত। বন্দুক রাখুন। বন্দুক কঁাধেই ঝোলান ছিল ; পার্থীর থলেটাও সঙ্গে আনিয়াছিলাম। সেগুলা নামাইতে নামাইতে ঘরের চারি দিকে দৃষ্টিপাত করিলাম। ঘরের মাঝখানে একটা প্যাকিং বাক্সকে কাত করিয়৷ টেবিলে পরিণত করা হইয়াছে, তাহার উপর কেরোসিন ল্যাম্প রক্ষিত। ল্যাম্পের আলোয় দেখা গেল, ঘরটি মাঝারি আয়তনের, এক কোণে পুক ভাবে খড় পাতা রহিয়াছে, ইহাই বোধ হয় বর্তমান গৃহস্বামীর শষ্য । ইহা ছাড়া ঘরে আর কোন আসবাব নাই । ঘরের লবণ-জর্জরিত দেওয়ালগুলি যেন আপনার নিরাভরণ দীনতার কথা স্মরণ করিয়াই ক্লেদ-সিক্ত হইয়া উঠিয়াছে ।